মহেশতলা মিঊনিসিপ্যালিটির শেখ-পাড়া অঞ্চলটি পায়ে হেঁটে ঘুরলেই বোঝা যায় যে, এখানে গরিব মানুষের বসতি বেশি। আর এর সাথে যদি তাদের সম্বন্ধে তত্ত্ব-তল্লাশ চালানো যায়, তাহলে জানা যায় এই পাড়ার বেশির ভাগ বাসিন্দা দৈনিক রোজগারের ওপর নির্ভরশীল। তার ওপরে বেশ কিছু জনের কাছে রেশন-কার্ডের সুবিধে নেই। সমস্যাটির জটিলতা আরো একটু বেশি। কারণ এই অঞ্চলের ভাড়াটে বাসিন্দাদের সংখ্যা কিছু কম নয়। শহর কলকাতায় রাজ-মিস্ত্রির কাজ, রং-মিস্ত্রির কাজ, ছোট কারখানায় শ্রমিকের কাজ, আয়ার কাজ, হকারির কাজ ইত্যাদি - করতে যাওয়ার জন্য বজবজ স্টেশন লাগোয়া এই শেখ পাড়ায় এক কামরার খোলার চালের বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকাটা অনেকের কাছে অর্থনৈতিক সুরাহার উপায়।
লক-ডাউনের পর থেকে এই সকল খেটে খাওয়া পরিবারগুলি রোজগার-বিহীন। যে পরিবারগুলির মহিলারা আশেপাশেরর পাড়ায় পরিচারিকার কাজ করেন, তাদের রোজগার একদম না চলে গেলেও, তার পরিমাণ কমেছে। কারণ বহু বাড়ি তাদের শুধু কাজে আসতে বারণ ই করেনি, তাদের প্রাপ্য মাস-মাইনে থেকেও টাকা কেটে নিয়েছে বা মাইনে দেয়নি।
এমন সময় যে সকল পরিবারের কাছে রেশন-কার্ড আছে, বা যাদের নামে ফুড-কুপনের শিকে ছিঁড়েছে, তাদের মাসিক চাল জোগাড়ের চিন্তা কমলেও, যাদের কাছে রেশন-কার্ড বা ফুড কুপন নেই, তাদের অবস্থা বেশ সঙ্গীন। লক ডাউনের পর শেখ পাড়ার বাসিন্দাদের জন্য ফুড রিলিফ ক্যাম্প চালাতে গিয়ে জানতে পারা যায় যে, ক্যাম্পে রিলিফ নিতে আসা প্রায় তিরিশ-চল্লিশ জনের কাছে রেশন কার্ডের সুবিধে নেই। এদের মধ্যে আবার বয়স্ক মহিলার সংখ্যা বেশি এবং তাদের অক্ষর জ্ঞান নেই।
এনাদের মধ্যে প্রায় তেরো জনের জন্য টেম্পোরারি কুপনের ফর্মটি ভর্তি করে মহেশতলা ওয়ার্ড অফিসে জমা দিতে যাই। জানতে পারি মিঊনিসিপ্যালিটির অফিসে গিয়ে জমা দিতে হবে। সেখানে গিয়ে যখন জানাই যে, টেম্পোরারি ফুড কুপনের ফর্ম জমা দিতে এসেছি, আমাকে প্রথম ডেস্ক থেকে দ্বিতীয় ডেস্কে জনৈক বল্লভ বাবুর কাছে পাঠানো হয়। তিনি দেখলাম টেম্পোরারি ফুড কুপনের ফর্ম ও কুপন সনংক্রান্ত কাজে ব্যস্ত। তাঁর কাছে ফর্মটি জমা দেওয়ার আর্জি জানাতে তিনি আমাকে সুকান্ত বেরা মহাশয়ের কাছে পাঠান। তিনি নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং পদ অধিকার করে আছেন।
পুনরায় তাঁর কাছে টেম্পোরারি ফর্ম জমা দেওয়ার আর্জি জানালে পরে তিনি প্রথমেই খুব রূঢ় ভাষায় প্রশ্ন করেন যে, আমি কীভাবে এই ফর্মের হদিশ পেলাম। তারপর তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন যে আমি পরিযায়ী শ্রমিক কী না? কারণ তাঁর মতে ওই ফর্মটি পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য। আমি ফর্মের ওপরে থাকা “ person not having digital ration card or coupon”শব্দবন্ধটির প্রতি তাঁর দৃষ্টি-আকর্ষণ করলে পরে তাঁর রূঢ়তা আরো বাড়ে।। তাঁকে যখন বলতে চাই যে আমার কাছে সেই সব মানুষের আবেদন আছে, যাদের রেশন কার্ড নেই, তিনি সে কথায় কর্ণপাত না করে আমাকে চলে যেতে বলেন। ফুড ইন্সপেক্টরের কাছে আমাকে ঢুকতেই দেওয়া হয় নি।
তর্কের খাতিরে যদি ধরেই নিই যে, টেম্পোরারি ফর্ম পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য নির্দিষ্ট, তাহলেও ফর্মটি জমা নিতে বাধা কোথায় ছিল? আবার এনাদের মধ্যে কেউই আমাকে এটা জানানোর প্রয়োজন ও বোধ করলেন না, যে যাদের রেশন কার্ড নেই, তারা কীভাবে আপাতত রেশনের সুবিধা পাবে? বা পরিযায়ী শ্রমিক প্রমাণ পত্র টি ঠিক কীভাবে জোগাড় করতে হয়? স্রেফ ভাগিয়ে দেওয়া হল। আধিকারিকারা পার্টি কর্মীদের নিশ্ছিদ্র ঘেরাটোপের মধ্যে এমন লুক্কায়িত, যে তাদের কাছহ অবধি যাওয়ার উপায় নেই।
বজবজ লোকাল চালু না হলে পরে এনাদের হাতে কাজ আসবে না। অতিমারীর সময়ে তাঁরা ফিরে গিয়েও কতটা কাজ পাবেন তাও অনিশ্চিত। এক্ষেত্রে যেটা সুনিশ্চিত হতে পারত/ পারে তা হল রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে এনাদের খাদ্য-সুরক্ষাটি সুনিশ্চিত করা। কিন্তু পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে পুনরায় সার্ভে করে দেখা যে, কে বা কারা রেশনের সুবিধা পাচ্ছেন না-তা অন্তত শেখপাড়ায় হচ্ছে না। রেশন পেতে গেলে গরিব মানুষগুলিকে এই দুঃসময়েও যে পরিমাণ হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে, তাতে সরকারের ভাব -মূর্তি যে উজ্জ্বল হচ্ছে না, তা পুনরায় উল্লেখের অবকাশ রাখে না।