২০২৩ এ কলকাতা আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল (KIFF) এ কুর্দিশ ফিল্মমেকার মানো খলিল এর সাথে বন্ধুত্ব হয় - বহুক্ষণ ধরে ওনার কুর্দিশ জনজীবনের কথা, অভিবাসী কুর্দিস্তান যা এখন চারটে দেশে ছড়িয়ে কুর্দ জনজাতি ই আজ সম্পূর্ণ আপন ভূমেই উদ্বাস্তু।
বিশ্ব ব্যাঙ্ক ২০২৩ সালে তার একটি রিপোর্ট এ বলেছিল : অভিবাসী এবং অ-অভিবাসীর মধ্যে প্রধান পার্থক্য হল গন্তব্য দেশের নাগরিকত্ব (বা এর অভাব) এবং এর সাথে সম্পর্কিত এক অধিকার। একবার একজন অভিবাসীকে স্বাভাবিকীকরণ করা হলে, তারা আর অভিবাসী থাকে না: তারা অন্যান্য নাগরিকদের মতো একই চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগের মুখোমুখি হয়-যদিও কিছু ক্ষেত্রে জাতীয় সংখ্যালঘুদের মতন অতিরিক্ত অসুবিধার সম্মুখীন হয়। অথচ, যে সব মানুষ, বাচ্চা, মহিলা, বুড়ো কী যুবক, যারাই ওপার থেকে আসে, তাদের অবস্থার কথা কেউ কি জানে ভাল করে? জানে কি, কেন তারা এত সমস্যা, এত বিপদ পেরিয়ে এ দিকে চলে আসতে চান? মানুষ একটু বাঁচার তাগিদে আইন ভেঙে এ পারে আসে। কাগজপত্র নেই বলে অমানুষের মতো আমরা তাদের তাড়িয়ে দিতে পারি? অথচ,আমেরিকা কিন্তু অভিবাসীদেরই দেশ। সে ইতিহাস ভুলে গেলে ইতিহাসও লজ্জা পাবে।
সুতরাং অভিবাসী জীবনই মানব সমাজযাত্রায় অন্যতম বিবরণ। প্রারম্ভিক মানুষের বসতিসমূহ জলের উৎসের কাছাকাছি ছিল এবং জীবনধারণের উপর ভিত্তি করে বেঁচে থাকার জন্য তারা অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করতো, যেমন - শিকারের জন্য পশু, এরপরে শস্য চাষের জন্য জমি এবং গবাদি পশু। মানুষ প্রযুক্তি ব্যবহার করে আবাসনের পরিবর্তন করেছিল, যেমন - সেচ, নগর পরিকল্পনা, নির্মাণ, পরিবহন, উৎপাদন সামগ্রী, বনভূমি উজাড় এবং মরুকরণ এর মাধ্যমে।প্রায়ই বাসস্থান পরিবর্তন করার মূল কারণ ছিল বস্তুগত সম্পদ বৃদ্ধি, জ্বালানির উৎস বৃদ্ধি, খাদ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি, নৃতাত্ত্বিক উন্নতি, বা সম্পদ বা অন্যান্য মানব বসতিগুলির অ্যাক্সেসের সুবিধার উন্নতির লক্ষ্যে কাজ করা। বড় আকারের বাণিজ্য ও পরিবহন অবকাঠামোর উন্নয়নের ফলে এই সম্পদগুলির কাছাকাছি থাকা অপ্রয়োজনীয় হয়ে ওঠেছিল এবং অনেক স্থানেই এগুলি জনসংখ্যার বৃদ্ধি এবং হ্রাসের পিছনে একটি চালিকা শক্তি হয়। তথাপি, যে পদ্ধতিতে বাসস্থান পরিবর্তিত হয় তা প্রায়ই জনসংখ্যার পরিবর্তনের একটি প্রধান নির্ধারক হিসাবে কাজ করে।
প্রযুক্তি দ্বারা মানুষ সব মহাদেশে উপনিবেশ স্থাপন করতে এবং জলবায়ুর সাথে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল। গত শতাব্দীর মধ্যে মানুষ এন্টার্কটিকা সমুদ্রের গভীরে এবং বাইরের স্থান অনুসন্ধানও করেছে, যদিও এই পরিবেশের বৃহৎ পরিসরে ঔপনিবেশীকরণ এখনও সম্ভবপর নয়। স্তন্যপায়ী প্রাণীগুলির মধ্যে মানুষই সংখ্যায় বেশি, প্রায় ৭ বিলিয়ন এর উপর জনসংখ্যা। অধিকাংশ মানুষ (৬১%) এশিয়ায় বাস করে। অবশিষ্ট লোক আমেরিকায় (১৪%), আফ্রিকায় (১৪%), ইউরোপে (১১%) এবং ওশেনিয়ায় (০.৫%) বসবাস করে। এগুলো ভাবতেই হবে উদ্বাস্তু ও অভিবাসী দের যাপন জীবন অনুভব করতে হলে।
উদ্বাস্তু সমস্যা, তাদের গল্পগাথা-সাহিত্য, গোটা ইউরোপ ও এশিয়ার অভিবাসীয় ইতিহাস ও চলচ্চিত্র নিয়ে আমরা মানো খলিলের সাথে গল্পে রত ছিলাম বহুক্ষণ। মানবতার স্মৃতি - তার দর্শন , সাহিত্য , শিল্প ও ইতিহাস নিয়ে আমরা কয়েকটি পর্বে আলোচনা , দেখা ও পরস্পরকে বোঝা এবং আত্তীকরণ শুধুমাত্র শেয়ার করার মাধ্যমেই নয় , বেশ কিছু কুর্দ সিনেমা একসাথে দেখলাম , যেন , মনে হয়েছিল - কত কাছ থেকে যেন পরস্পরকে আত্মীয় মনে করতে পারছি।
মানো খলিল, এমন এক কুর্দিশ চলচ্চিত্র নির্মাতা যিনি তার সম্প্রদায়ের জন্য লড়াই করার জন্য বন্দুকের পরিবর্তে একটি ক্যামেরা মোতায়েন করেছেন', তার ছবি 'দ্য বি-কিপার' দেখলেই মনে হয় কথাটা একটুও অত্যুক্তি করে বলেননি তিনি নিজের সম্পর্কে। অক্টোবর ২০১৪ সালে, কুর্দি চলচ্চিত্র নির্মাতা মানো খলিল তার সাম্প্রতিক ডকুমেন্টারি, 'দ্য বি-কিপার'-এর স্ক্রীনিংয়ের জন্য হাজার হাজার তিব্বতি নির্বাসিত অধ্যুষিত উত্তর ভারতীয় শহর ধর্মশালায় এসেছিলেন।
এডওয়ার্ড সাঈদ একবার লিখেছিলেন যে নির্বাসিত হওয়া মানে বাড়ির ধারণা থেকে বিচ্ছিন্ন বোধ করা নয়, বরং আপনার জীবনের প্রতিটি দিন মনে করিয়ে দেওয়া যে "আপনি নির্বাসনে আছেন, আপনার বাড়ি আসলে এত দূরে নয়।"
যদিও দ্য বি-কিপার ফিল্ম স্ক্রিনিংটি প্রথমে দালাই লামার বাসভবন-এর শহর ধর্মশালায় দেখানো হয় কারণ তিনি নির্বাসিত রাজ্যগুলির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত যেখানে মানুষ আপন জন্মস্থানেই রাজনৈতিকভাবে পরাভূমবাসী ; যেমন তিনি নিজেই তার জন্মস্থান সিরিয়া থেকে ওখানকার বাথবাদী শাসনে বাধ্য হয়ে পালিয়ে যাওয়ার পর বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে সুইজারল্যান্ডে বসবাস করেছেন।
সিরিয়া ১৯৪৫ সালে একটি সংসদীয় প্রজাতন্ত্র হিসাবে আবির্ভূত হয় এবং তা জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হয় । ১৯৪৫ সালেই ফরাসি ম্যান্ডেটের অবসান ঘটায়, যার আগে এই অঞ্চলটি ওটোমান শাসনের অধীনে ছিল। এরপরে, ১৯৬৩ সালে, একটি বাথবাদী অভ্যুত্থান হয় ও বাথ পার্টি তার ক্ষমতা বজায় রাখে।
১৯৬৩ থেকে ২০১১ পর্যন্ত, দেশটি জরুরী অবস্থার মধ্যে ছিল, যার অর্থ নাগরিকদের সাংবিধানিক সুরক্ষা সঙ্কুচিত থাকে। বর্তমানে, সিরিয়া একটি একক প্রজাতন্ত্র। রাজনৈতিকভাবে বাথিজমকে সমর্থন করার জন্য বহুদিন ধরে এটি একমাত্র দেশ। বাথবাদ , আরব জাতীয়তাবাদ, প্যান-আরবিবাদ এবং আরব সমাজতন্ত্রের পাশাপাশি সামাজিক অগ্রগতির নীতির উপর ভিত্তি করে এটি একটি ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ বলে ওরা ঘোষণা করে। ১৯৬৩ সাল থেকে, বাথ পার্টি সিরিয়ায় ক্ষমতায় রয়েছে এবং বর্তমান সিরিয়ার রাষ্ট্রপতি বাশার আল-আসাদ, যিনি ২০০০ সাল থেকে ক্ষমতায় রয়েছেন। তিনি তার পিতা, হাফেজ আল-আসাদের স্থলাভিষিক্ত হন, যিনি ১৯৭১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি ছিলেন। অতএব যতোই এরা গণতান্ত্রিক হোন, সিরিয়ার সরকার তাই এক ধরনের ব্যক্তিবাদী একনায়কত্ব বলে সমালোচিত। এইরকম নানান ধরণের সরকারপক্ষ ও বিরোধী দের পারস্পরিক ও বিরোধী রাজনৈতিক বয়ান সিরিয়ায় বর্তমান।
বাথবাদী শাসনের বিরুদ্ধে বিশেষ করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং মুক্ত সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে নিপীড়ন করার বহুল প্রচারিত অভিযোগ আছে এবং তা ভূবন জুড়ে। অন্যপ্রান্তের চিত্র নোগালেস। নোগালেস দেখতে যেতে হবে, নোগালেস নিয়ে তর্ক করতে হবে, নোগালেস নিয়ে সমবেদনা জানাতে হবে, নোগালেস নিয়ে ভয় পেতে হবে আর ‘গোটা’ নোগালেসকে ভালবাসতে হবে। কেন? কারণ নোগালেস এমন একটা শহর, যার বুক চিরে চলে গিয়েছে আমেরিকা-মেক্সিকো সীমান্ত। যে শহরের এ দিকে আর ও দিকে লোকে একই ভাষা বলে, একই খাবার খায়, একই গান গায়, একই স্বপ্ন দেখে। অথচ মাঝখানে কাঁটাতার। যে কাঁটাতারের এক দিকে একটা থিতু জীবনের হাতছানি, অন্য দিকে খুব কষ্টে দিনযাপনের গ্লানি। আর তাই নোগালেসের যে দিকটা আমেরিকায়, যে দিকে হাজার পঞ্চাশেক লোকের বাস, সেই দিকে বেআইনি পথে রোজ বর্ডার পার করে হাজার হাজার মেক্সিকান অভিবাসী আসে ও পারের নোগালেস থেকে, যেখানে প্রায় লাখ পাঁচেক লোকের বসতি।
কিন্তু, পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে সিরিয়া, তুরস্ক, ইরাক এবং ইরানের মধ্যে বিভক্ত সন্নিহিত অঞ্চলে প্রায় ৩০ মিলিয়ন কুর্দি বাস করে, যা তাদের বিশ্বের বৃহত্তম রাষ্ট্রহীন জাতিগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। কুর্দিরা এই অঞ্চলের সবচেয়ে নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের মধ্যে একটি। দ্য বি-কিপার স্ক্রীনিংয়ের একদিন পর ধর্মশালায় অনুষ্ঠিত এক সাক্ষাৎকারের সময় খলিল বলেছিলেন, “এটা বলাই যথেষ্ট যে একজন কুর্দি ছিলেন কারারুদ্ধ।"
তিনি নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই কথাগুলো বলেছেন। ১৯৮০-এর দশকের শেষদিকে প্রাক্তন চেকোস্লোভাকিয়ার একজন চলচ্চিত্র ছাত্র হিসাবে, খলিল একটি ম্যাগাজিনের সাক্ষাৎকারে তার কুর্দি পরিচয় উল্লেখ করেছিলেন। দামাস্কে ফিরে আসার পরই তাকে এই অপরাধে জেলে পাঠানো হয়।
খলিল নিজের কথা বলছিলেন - "চলচ্চিত্র নির্মাণ একটি সৃজনশীল সাধনার মতোই একটি রাজনৈতিক কাজ।" তিনি বলছিলেন যে তিনি "সেই লড়াই চালিয়ে যেতে" বন্দুকের পরিবর্তে একটি ক্যামেরা তুলেছিলেন — কুর্দি রাষ্ট্রের জন্য লড়াই, গণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই এবং রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে কুর্দি পরিচয় পুনরুদ্ধার করার লড়াই।
কুর্দিশ সিনেমা ( ইন সার্চ অফ আইডেন্টিটি):
'দি সোয়ালো' (সুইজারল্যান্ড)/পরিচালক : মানো খলিল।
(২০১৬/কালার/১০২ মিনিট/সুইস-জার্মান সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ)
একটি বিবর্ণ ছবি এবং একটি চিঠি নিয়ে, ২৭-বছর-বয়সী মীরা সুইজারল্যান্ড থেকে ইরাকের কুর্দিস্তান অঞ্চলে যাত্রা করে বাবাকে খুঁজতে যার সাথে তার কখনও দেখা হয়নি৷ ছবিটি কলকাতা আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল এ ২০২৩ এ প্রদর্শিত হয় ,ফিল্মটিতে যেখানে, একবার, তিনি সহিংসতা এবং সন্ত্রাসবাদের মুখোমুখি হন, কিন্তু প্রেমও খুঁজে পান।
মানো খলিলের অন্য একটি ডকুমেন্টারি - দ্য প্লেস হোয়্যার গড স্লিপস - এটি সিরিয়ায় খলিলের একমাত্র ছবি। ১৯৯৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত, ছবিটি সিরিয়া এবং তুরস্কের সীমান্তের মধ্যে বসবাসকারী কুর্দি সম্প্রদায়ের সদস্যদের জীবনধারা ও যাপনকে ধরে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ,মানবতার পক্ষে এক জার্নি এই ছবি। জার্মানির ওগসবার্গ ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রথম পুরস্কার জিতে এই ছবিটি ভালরকম সমাদৃত হয়েছিল। কিন্তু চলচ্চিত্রটির আন্তর্জাতিক সংবর্ধনার পর, খলিল বলেছিলেন, সিরিয়ায় তার এবং তার পরিবারের জন্য "নরকের দরজা খুলে গেছে", এবং তিনি দেশ ছেড়ে সুইজারল্যান্ডে পালিয়ে যান, যেখানে তিনি পরে নাগরিক হন।
বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে, ফিচার ফিল্ম এবং ডকুমেন্টারি উভয়ের মাধ্যমে, খলিল জাতিগত দমন, বাস্তুচ্যুতি এবং ক্ষতি সহ কুর্দি অভিজ্ঞতার কেন্দ্রীয় বিষয়গুলি অন্বেষণ করে চলেছেন। তার ২০০৫ সালের ডকুমেন্টারি, আল-আনফাল: আল্লাহর নামে, বাথ এবং সাদ্দাম, ১৯৮০ এর দশকে উত্তর ইরাকের কুর্দি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সাদ্দাম হোসেন যে 'পবিত্র যুদ্ধ'-এর নামে যে সন্ত্রাস পরিচালনা করেছিলেন , ছবিটি তারই একটি তদন্তমূলক প্রমাণ সাপেক্ষ ডকুমেন্টারি ।
২০০৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ডেভিড দ্য টলহিলদান, সুইস নাগরিক ডেভিড রুইলারকে অনুসরণ করে যখন তিনি কুর্দি মুক্তি আন্দোলনে যোগদানের জন্য পশ্চিমা বিশেষ সম্পন্নতা ও স্বচ্ছল জীবনের অধিকার থেকে নিজেকে চ্যুত করেন। দ্য বি-কিপার-এ সেই নির্দিষ্ট আখ্যানের চাপটি উল্টে দেওয়া হয়েছে, যা সুইজারল্যান্ডে একজন কুর্দি শরণার্থীর জীবন অন্বেষণ করে। ছবিতে, ইব্রাহিম গেজার তার পরিবার হারানোর শর্তে মৌমাছি পালনের জন্য তার আবেগ অনুসরণ করেন: কিছু যুদ্ধ-বিধ্বস্ত তুরস্কের কুর্দিস্তানে থেকে গেছেন; তার ছেলে সহ অন্যরা কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির সাথে লড়াইয়ে নিহত হয়।
খলিল কুর্দি এবং আরবি বলতে তো সড়গড় ছিলেনই বড় হয়েছিলেন ওই ভাষাগুলোই শিখে, যদিও পরে চেক, জার্মান, সুইস জার্মান এবং ইংরেজিতে পারদর্শী হয়েছিলেন। তিনি আমার সাথে সরল ইংরেজিতে কথা বলেছেন, যদিও তিনি নিয়মিতভাবে তার সাবলীলতার অভাবের জন্য ক্ষমা চেয়েছিলেন।
"মাঝে মাঝে আমি ভাবতাম যে একটি ক্যামেরা, যা শব্দের চেয়ে আলোর হেরফের মাধ্যমে সত্য প্রকাশ করে, এটি আরও আরামদায়ক প্রমাণিত হতে পারে। যখন ছবিটি শুরু হয়, তুর্কি বাহিনীর দ্বারা গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের পর ইব্রাহিম ইতিমধ্যেই পাহাড়ে লুকিয়ে সাত বছর কাটিয়েছেন।" মানো খলিল বললেন তার ছবির সম্পর্কে। ছবিতে সুইজারল্যান্ডে, যখন তিনি চৌষট্টি বছর বয়সে শুরু থেকে তার জীবন পুনর্নির্মাণ করেন, মৌমাছি পালন - একটি শৈশব উৎসাহ - অতীতের সাথে তার একমাত্র যোগাযোগ।
ইব্রাহিম এক পর্যায়ে ক্যামেরার দিকে চেয়ে দর্শকদের বলে , “তারা যখন আমাকে দংশন করে তখন আমি এটা পছন্দ করি।" এই "শখ", যেমন সুইস কর্তৃপক্ষ অপমানজনক ভাবে এটিকে বলে, তখনই বোঝা যায় এটিই প্রতিবাদের স্বাভাবিকতা এবং ধারাবাহিকতার প্রতীক।
কুর্দিশ আরেকটি ছবি : 'কিক অফ' (ইরাক)/পরিচালক : সওকত আমিন কোরকি
(২০০৯/কালার/৮১ মিনিট/সেন্ট্রাল কুর্দিশ) -
সাদ্দাম হোসেনের প্রশাসন থেকে বাঁচতে শরণার্থীরা একটি মারধর করা স্টেডিয়ামে আশ্রয় নেয়। দরিদ্র মানুষের জন্য আনন্দের একমাত্র উৎস হল ফুটবল, এবং কুর্দি, আরব এবং তুর্কি জনগণকে ফুটবল খেলার জন্য জড়ো হয়। এই নিয়ে সামাজিক নানান বিন্যাস যেখানে পৃথিবীর চোখে কুর্দিশ 'অপর' ; এই এই খেলার মজায় যেন বুক ফেটে আসে , 'হায়! কোথায় আমাদের স্বাধীনতা! আমরা 'অপর'?'
(পরিচালকের জীবনী: ১৯৭৩ সালে কুর্দিস্তান অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন, ।শওকত আমিন কোরকি এবং তার পরিবার তৎকালীন ইরাকি সরকারের দমন-পীড়নের ভয়ে ইরাক থেকে পালিয়ে যান এবং ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত ইরানে থাকেন। তিনি ২০০৬ সালে তার প্রথম ফিচার 'ক্রশিং দ্য ডাস্ট' দিয়ে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেন, যার প্রিমিয়ার হয়েছিল রটারডাম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে।
'কিক অফ্' বুসান সহ বিশ্বের বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে পুরষ্কার জিতেছে, যখন এনারই ছবি মেমরিস অন স্টোন (২০১৪) ইরাকের অফিসিয়াল একাডেমি পুরস্কার পেয়েছে।
প্রাচ্যের অন্যরকম সংষ্কৃতিকে পশ্চিমী দুনিয়া তার মতন করে নির্মাণ করে নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, বিশেষত ষাট ও সত্তর দশকের সমস্ত ধরণের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের কাছে আনত অসম্ভব এক মানব-বিশ্বে এডওয়ার্ড সাঈদের আবির্ভাব প্রচন্ড আলোড়নের মতো, যা নাড়িয়ে দেয় পশ্চিমের সাংষ্কৃতিক আধিপত্য ও দমনের দীর্ঘ, স্থিতিশীল আয়োজন-উন্নত বিশ্বের সাংষ্কৃতিক প্রভাবনের সূত্রে অর্জিত ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের মূল-ভিত্তির কৃত্রিম গ্রন্থিগুলো খুলে খুলে দেখায়, এবং এভাবে অনুন্নত অঞ্চলগুলোর, বিশেষ করে প্রাক্তন, উপনিবেশ অধ্যুষিত দেশগুলোর মানুষদের চিন্তাভঙ্গির দীর্ঘকালীন উপনিবেশিক আবর্তনের মধ্যে সূচনা সুপ্তভাবে তৈরি হয়েই থাকে অবমুক্তি ও বিকাশের তীব্র সম্ভাবনা। অরিয়েন্টালিজম বা প্রাচ্যতত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সাঈদ বলেছিলেন,প্রাচ্য হল পশ্চিমের জ্ঞান জগতের নির্মাণ;পশ্চিমের কাছে প্রাচ্য ছিল দূর ও অজানা। সেই দূর ও অজানাকে জানার চেষ্টায় প্রাচ্য হয়ে ওঠে পশ্চিমের অন্য বা 'আদার' - যা পশ্চিমের প্রতিপক্ষ। ফলে পশ্চিম(নিজ) হয় ভাল , আর প্রাচ্য (অন্য) হয় মন্দ। সেই দর্পেই ক্ষমতাবান তকমায় পশ্চিমী নাগরিকরা পর্যন্ত সাংষ্কৃতিক হয়ে ওঠে ক্ষমতাহীনদের প্রতি 'ওরা' বা 'আদার' বয়ানে। কিন্তু এ প্রাচ্য বাস্তব প্রাচ্য নয়, পশ্চিমের সৃষ্টি মাত্র। পশ্চিম প্রাচ্যে তার উপনিবেশ গড়ার বহু আগে থেকেই প্রাচ্যের ইতিহাস, জনগোষ্ঠী, সংষ্কৃতি, বিশ্বাস ও আচার সম্পর্কে অজস্র কাল্পনিক ধারণা প্রসব করেছে, প্রচার করেছে এবং প্রজন্মক্রমে তা বিশ্বাসও করেছে। সে কল্পনা ও ধারণার মূলে আছে পশ্চিমের এক বীরত্ববোধ ,নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির ও প্রাচ্যের নিকৃষ্টতার বোধ-বিশ্বাসে আঁকড়ে থাকা। বলাই বাহুল্য,এই দূরত্ব আর ঘোচেনি। ১৯৮০ সালে লেখা সাঈদের 'দি কোয়েশ্চেন অফ প্যালেস্টাইন' আমাদের সময়ের তীব্র,রক্তক্ষয়ী আন্তর্জাতিক সংঘাতের রাজনীতির উপর আলোকপাত। ইজরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কারণে দেশচ্যুত, রাষ্ট্রচ্যুত ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার জীবন্ত চিত্র ঐ ডকুমেন্টেড গ্রন্থ। লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনি আজ ছড়িয়ে আছে সারা পৃথিবীতে। তাদের দেশ নেই , ভোট নেই , নাগরিক অধিকার নেই। সাঈদের এখানেই প্রশ্ন।পশ্চিমে এমন একটি দিনও পার হয় না যেদিন ফিলিস্তিনিরা প্রধান প্রধান সংবাদের শিরোনামে অন্তর্ভুক্ত থাকে এবং পশ্চিমী প্রচারমাধ্যম তার যে ইমেজ নির্মাণ করেছে ,তা হল এক খুনী, সন্ত্রাসকারী, অপহরণকারী, সর্বহারা শরনার্থীর এক গাথা। ফিলিস্তিনিরা আজ ঐ পশ্চিমা প্রচারমাধ্যমের এক কৃত্রিম, ঘৃণ্য, রাজনৈতিক ইমেজে বন্দি। তাই, স্বাভাবিক প্রশ্ন আসে, প্রকৃত বুদ্ধিজীবী কে? প্রকৃত বুদ্ধিজীবী আসলে নিঃসঙ্গ মানুষ। তারা পরবাসী, সংখ্যালঘু এবং অপেশাদার। পরিচ্ছন্ন মানসিকবোধ, চিন্তার অবিচ্ছিন্ন সততা, সজাগ চৈতন্য - এই হল বুদ্ধিজীবীর আজন্ম সম্বল। অনিচ্ছাকৃত অভিবাসনের মধ্যে রয়েছে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি (বিভিন্ন রূপ যেমন নির্বাসন, দাস বাণিজ্য, যুদ্ধ শরণার্থী এবং জাতিগত নির্মূল। এ কথা বলার মতন যুক্তি ও অ-নির্মাণ তথ্য নিয়ে আন্দোলনে সরাসরি যুক্ত হয়ে প্রতিবাদী মানুষেরাই তো আসল বুদ্ধিজীবী।
ছবিঃ মান্দু (ইরাক)/পরিচালক : ইব্রাহিম সাইদী
(২০১০/কালার/৯০ মিনিট/সেন্ট্রাল কুর্দিশ)
১৯৭৯ সালে ইরান থেকে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অনেক ইরানি কুর্দি তাদের মাতৃভূমি ছেড়ে ইরাকে আশ্রয় চেয়েছিল। শীলান, কুর্দি বংশোদ্ভূত একজন তরুণ ডাক্তার যার বাবা-মা সুইডেনে পালিয়ে যেতে পারে, ২০০৪ সালে তার চাচার খোঁজে ইরাকে ফিরে আসে। স্ট্রোকের পরে চাচা কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন এবং তার ছেলে তাকে তার জন্মভূমিতে ফিরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। শীলান তাদের সাথে ইরানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় যা দীর্ঘ এবং ঘটনাবহুল হবে।
(পরিচালকের জীবনী: ইব্রাহিম সাইদী (জন্ম: ১৯৬৫) একজন চলচ্চিত্র সম্পাদক এবং পরিচালক। তিনি ৩৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে চিত্রনাট্য লেখা এবং ফটোগ্রাফির ক্ষেত্রে কাজ করছেন সাইদীর উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলির মধ্যে রয়েছে ক্লান্ত (মান্ডু, ২০১০), ইক্লিপস (রৌজগিরান, ২০০১) এবং অল মাই মাদারস (২০০৯)।)
মানো খলিলের প্রসঙ্গ বারবারই এসে পড়ে তার প্রতিবাদী ভাষা নিয়ে সিনেমার জগতে। তিনি পশ্চিম কুর্দিস্তান থেকে এসে দামেস্ক ইউনিভার্সিটিতে ইতিহাস ও আইন নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। ১৯৮৬ সালে সাবেক চেকোস্লোভাকিয়ায় গিয়েছিলেন এবং চলচ্চিত্র পরিচালনার বিষয়ে পড়াশোনা করেছিলেন, বিশেষ করে রোমানিয়ান চলচ্চিত্রের উপর। তারপর,১৯৯৩ সালে অনার্স সহ স্নাতক হন এবং চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন পরিচালনায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রিও অর্জন করেন। তিনি সাবেক চেকোস্লোভাকিয়ার টেলিভিশন চ্যানেলে কাজ করতেন। এই দেশও দুই ভাগে ভাগ হওয়ার পর স্লোভাকিয়ার টেলিভিশন চ্যানেলে কাজ করেন। ১৯৯০ থেকে ১৯৯২ সালের মধ্যে, তিনি বেশ কয়েকটি নাটকীয় চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন, কিন্তু ১৯৯৪ সালে স্নাতক হওয়ার পর থেকে তিনি ১ হাজার টিরও বেশি টেলিভিশন প্রতিবেদন এবং বিজ্ঞাপনের শুটিং করেছেন। টিভি অনুষ্ঠান পার্টি 'বাবল্'-এর পরিচালক হিসেবে পাঁচ বছর কাজ করেছেন ,ক্ল্যান্স এবং ক্লুরিয়া নামে আরেকটি টিভি অনুষ্ঠানের শুটিং করছেন।
বর্তমানে তিনি ফিল্ম এবং টেলিভিশনে নিবেদিত, রোমানিয়ান ডকুমেন্টারিগুলির জন্য একজন স্বাধীন পরিচালক, প্রযোজক এবং সিনেমাটোগ্রাফির পরিচালক হিসাবে কাজ করছেন। মানো ১৯৯৬ সাল থেকে সুইজারল্যান্ডে বাস করা কালীন এ পর্যন্ত ১৪টি পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবিতে পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন।
তার অন্যতম আন্যান্য চলচ্চিত্রগুলি : আনফাল (২০০৫), ডেভিড তুলহিলদান (২০০৬), মাই প্রিজন, মাই হোম (২০০৯)। তার চলচ্চিত্রের বিষয়গুলোই খুবই ঘনিষ্ঠভাবে দেখা হয়; যেমন, উদাহরণস্বরূপ, দুবাই ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ডেভিড তুলহিলদান(২০০৬)-এর প্রদর্শনের কয়েক ঘন্টা আগে, তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমির এমিরেটস্ এর দূতাবাসের মাধ্যমে, ছবিটি প্রদর্শনের অনুমতি দেয়নি। তুরস্কও ছবিটিকে সিঙ্গাপুর চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হতে বাধা দিয়েছিল।
ডকুমেন্টারি ফিল্মমেকার মানো খলিল, যার ফিল্ম দ্য বি কিপার এর ভারতে প্রিমিয়ার হয়েছিল ডিআইএফএফ-এ। উঁচু থেকে হাই এ্যাঙ্গেল টপ শট্ এর মাধ্যমে কুর্দিশ শরণার্থীদের যাপন-দুর্দশার উপর ক্যামেরা প্যান করা এবং একটি উন্নত জীবনের জন্য তাদের সংগ্রামের বর্ণনা দিয়েছেন । যেমন,বেশিরভাগ কুর্দি শরণার্থী, সুইজারল্যান্ড বা ইউরোপের অন্যান্য অংশে, প্রধানত ভোজনশালা স্থাপনের জন্য পরিচিত, তাদের আঞ্চলিক সুস্বাদু খাবার যেমন শাওয়ারমা বা ডোনার কাবাব পরিবেশন করার জন্য কুর্দিরা বিখ্যাত। তবে তুরস্ক থেকে আসা কুর্দি শরণার্থী ইব্রাহিম গেজার ছিলেন ব্যতিক্রম (বি-কিপার)। ৬৫ বছর বয়সী তুর্কি-কুর্দ শান্ত আচরণের সাথে জীবনে কেবল একটি জিনিসই জানেন - মৌমাছি পালন। তার মৌমাছির উপনিবেশ (সংখ্যায় ৫০০) দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্কে একটি সম্মানজনক জীবনযাত্রার উৎস ছিল যতক্ষণ না তুর্কি কর্তৃপক্ষ এবং কুর্দি গেরিলা যোদ্ধাদের মধ্যে বিদ্রোহে মৌমাছি র উপনিবেশ গুলো কেড়ে নেয়। এই যুদ্ধ ইব্রাহিম গেজারের সবকিছু, তার স্ত্রী, সন্তান এবং আরও গুরুত্বপূর্ণ, তার মৌমাছির উপনিবেশ কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু তিনি আর কিছুই জানেন না এবং এখনও সে মৌমাছি থেকে মধু সংগ্রহ করেন, বলছিলেন ৫০ বছর বয়সী কুর্দি-সিরিয়ান চলচ্চিত্র নির্মাতা মানো খলিল, যিনি ভারতে তৃতীয় ধর্মশালা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে (ডিআইএফএফ) তার ডকুমেন্টারি দ্য বিকিপারের মাধ্যমে গেজারের গল্প - এই কথাগুলোই কলকাতায় এসে বলেছিলেন।
১০৭ মিনিটের ডকুমেন্টারিটির কুর্দি এবং জার্মান ভাষায় ফিল্মটি কুর্দিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের কারণে সিরিয়া ও তুরস্ক থেকে অজানা সংখ্যক কুর্দিদের বাস্তুচ্যুত (এবং কখনও কখনও নিখোঁজ) হওয়ার বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে গেজারের গল্পকে দেখায়। মানো খলিল কুর্দিশ ছবির চিরকালীন এক ভাষা যা আন্দোলনের ভাষা, স্বাধীনতার ভাষা , মানবতার ভাষা।
দুটি বিশ্বযুদ্ধ, হিংসাত্মক ও মায়োপিক জাতীয়তাবাদ এবং অসংখ্য স্থানীয় দ্বন্দ্ব শরণার্থীদেরকে আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার ব্যর্থতা এবং তাদের মধ্যে সম্পর্কের স্থায়ী প্রমাণে পরিণত করেছিল। শিল্প ও সাহিত্য এই ব্যর্থতা এবং এর মানবিক ফলাফলের প্রতিনিধিত্ব করে। ১৯৮০-এর দশকের আইকনিক কার্টুন সিরিজ - আর্ট স্পিগেলম্যানের 'মাউস' , পূর্ববর্তী ইউরোপীয় প্রজন্মের স্থানচ্যুতির যন্ত্রণা প্রকাশ করে। এর অনবদ্য গ্রাফিক শৈলীর নীচে, মাউস হল স্পিগেলম্যানের পিতা, একজন পোলিশ ইহুদি এবং একজন হলোকাস্ট সারভাইভারের একটি মর্মস্পর্শী সাক্ষাৎকার।
(পরের পর্বে সমাপ্ত)