পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

সদ্য চাকরি হারা এক শিক্ষিকার কথা

  • 10 April, 2025
  • 0 Comment(s)
  • 1335 view(s)
  • লিখেছেন : টাম্পি আলম
বহু মানুষ বহু কথা বলছেন, চাকরিহারা শিক্ষকদের ডেকে মুখ্যমন্ত্রী আশ্বাস দিচ্ছেন, কিন্তু অনিশ্চিত হয়ে যাওয়া একজন মানুষের জীবন সেই সব কথা শুনতে নারাজ। তাঁদের দাবি, তাঁদের ন্যায্য চাকরি ফিরিয়ে দিতে হবে। আন্দোলন করতে গিয়ে জুটছে পুলিশের লাথি, লাঠি। সদ্য চাকরি হারা এক শিক্ষিকার আখ্যান থাকলো আপনাদের সামনে। কী করা উচিৎ, ভাবুন। এই মানুষদের হয়ে কথা না বলে শুধু রাজনীতি আপনি করতেই পারেন, কিন্তু তাতে কি খুব কিছু লাভ হবে?

আমার বাবার না পাওয়ার  লড়াই থেকে আমার লড়াই শুরু। বাবা যে স্বপ্ন দেখত সেই চোখখানি আর স্বপ্ন দেখেনা। অশ্রু ঝরে যে চোখে, সে চোখে স্বপ্ন ঝরে যায়। সালটা ১৯৯০ আমার বেকার স্বল্প শিক্ষিত বাবার কোল আলো করে আমার জন্ম। অতি শীর্ণকায় মেয়েটি বড় হতে লাগল একটু একটু করে। আমি আর আমার ছোট বোন একবছর পাঁচ মাসের ব্যবধানে বড় হতে থাকলাম। আমি গান আর নাচ, আঁকা শিখতে চেয়েছিলাম কোনওটাই হয়নি। কারন আর্থিক প্রতিবন্ধকতা। সামান্য ব্যবসা আর কৃষিহীন অনুর্বর মাটি ছিল সংসারের ভীত। ১৯৯৬ সালে চেল নদী বন্যায় সেই জমিও তছনছ হয়ে যায়। বালি ভরে জমি আরও কৃষির অযোগ্য হয়ে পড়ে। বাবা কোনমতে সংসার টেনে হিচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। তবুও আমাদের শহরের স্কুলে ভর্তি করায়। প্রতিদিন ৩৪ কিলোমিটার পথ যাতায়াত করতে হত। বাবা ছোটবেলা পুরোটাই সাইকেলে দিয়ে আসতো। তাঁর পর ১৯৯৬ সালে এলো ভ্যান, সেই ভ্যান কাকুর দু ঘন্টার বেশি সময় লাগত যেতে। সকাল ৭.৪৫ বেরোতাম, ফিরতাম সেই বিকেল পাঁচটা। এভাবেই চলল আমার আর আমার ছোট বোনের জীবন। ঘুম ঘুম চোখে পড়তে বসতাম। পাহারাদার আমার মা। চোখ বন্ধ করার উপায় নেই। আমার দিদি ছিল আমার নানির বাড়িতে। ২০০১ এলো আমার সাইকেল। যে শুধুমাত্র কাছ থেকে আমার লড়াই খানি দেখেছে।

'ভরা কুমলাইয়ের একবুক জলে কাঁধে নিয়ে সাইকেলখানি'।

আমাদের দু'বোনকে নদীতে নৌকা পার করতে হতো বলে বাবা নৌকা চালাতে শিখেছিল। কারণ ভরা বর্ষায় মাঝিরা নৌকা চালাতে চাইত না। বেশিরভাগ দিন নৌকা ঘাটে এক ঘন্টা ফিররার সময় দাড়িয়ে থাকতে হতো। চা শ্রমিকদের পার হবার পর আমার ঠাঁই মিলত। যখন নদীতে জল কম থাকত কাঁধে নিয়ে পার করতাম সাইকেল। প্রতিদিন জামা ভিজে যেত। শরীরে শুকাতো সেই জামা খানি। ভরা বর্ষায় কত যে স্কুল কামাই হয়েছে শুধুমাত্র নৌকা ভেসে যেত বলে। পাঁচ কিলোমিটারের বেশি পথ শুধুমাত্র চা-বাগান আর জঙ্গল।  বন্য পশুদের সঙ্গে সংগ্ৰাম করে চলে আমাদের জীবন যাপন। বাড়ির অনতিদূরেই আঁপালচাদ ফরেষ্ট। পেছনে চেল নদী, সামনে কুমলাই, প্রকৃতি আর মানুষ এই লড়াইয়ে আমাদের হার হলো ২০০২ সালে। আমার শৈশবকালের সহচরী (আমার বোন) হারিয়ে গেল। বন্য পশু(হাতি) আমাদের কৃষি জমির ফসল তছনছ করে আমার বোনটাকে এক ভরা বর্ষায় কাছে টেনে নিল। যোগাযোগ ব্যবস্থা এতটাই খারাপ আমরা নূন্যতম চিকিৎসাটুকুও দিতে ব্যর্থ হই।   আমার শৈশবের বন্ধু আমার খেলার সাথি চলে যাওয়ায় ধীরে ধীরে আমি মানসিক অবসাদে তলিয়ে যাই। ২০০৪ থেকে ২০০৫ তিনবার ম্যালেরিয়া প্লাজমোডিয়াম ফেলসিফেরাম হল। কুইনাইন আর আমার জীবন চলতে থাকল বিষন্নতায়। তারপর দেখা দিল জন্ডিস। ডাক্তার বলল এমন চলতে থাকলে রোগীকে বাঁচানো যাবেনা। মাধ্যমিক পরীক্ষা ডাক্তার বারণ করা সত্ত্বেও আমি বসলাম। ২০০৫ আমি প্রথম বিভাগে উওীর্ণ হলাম। সেদিন খুব কেঁদে ছিলাম আরও ভালো রেজাল্ট আশা করেছিলাম। অবসাদের ঔষধ হয়ে উঠল আমার নিত্যদিনের সঙ্গী। মাসের ১৫টা দিন ঘুমের অতল গভীরে তলিয়ে থাকতাম। বাকি দিনগুলো স্বাভাবিক জীবনযাপন। ঐ অবসাদের দিনগুলোতে খাওয়ার সঙ্গে আমার বিবাদ ছিল। ঘুম ছিল আমার আপন। এবার ২০০৭ উচ্চমাধ্যমিক। মাধ্যমিকের প্রথম দিন সিক রুমে পরীক্ষা দিলাম, কারণ ঐ অবসাদ। বাংলা পরীক্ষা  তিন ঘন্টার পরীক্ষা এক ঘন্টায় শেষ। এভাবে চলল জীবন চাকা। দিদি বলল হ্যাঁ রে  পাশ করতে পারবি। আমি উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হলাম। এবার ভূগোল নিয়ে বাড়ি থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে কলেজে ভর্তি হলাম। আবার কঠিন লড়াই শুরু হল। ছয় মাস বাড়ি থেকেই কলেজ করতাম।  তারপর কলেযের পাশে কিছুদিন। ২০০৮ নানির বাড়ি থেকে কলেজ করেছি। প্রায় ৩৬ কিমি যেতে হত। এই ভাবে চলল তিনটে বছর। একেকটি ডিগ্রী একেকটি লড়াই স্তম্ভ লক্ষ্য ভেদ। সাধারণ নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম হয়ে শিক্ষিকা হতে চাওয়াটা একটা সাধারণ চাওয়া মনে হতেই পারে। কিন্তু তা আমার মতো অনেকের কাছে অনেক লড়াইয়ে পর হাসিল হয়েছে। আমার কাছের চরম শত্রুরাও বলতে পারবে না যে আমার কষ্টে তারা দুঃখ পায়নি। ২০১০ কলেজে পড়াকালীন আমি প্রাইমারি পাশ করি। ভাইভায় হয়নি। আবারো সেই নোংরা রাজনীতির শিকার। তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার সেই প্যানেলে প্রচুর  দুর্নীতি করেছিল। যাইহোক চাকরিটা আমার হয়নি। মাষ্টারস করে ২০১৩ স্বল্প বেতনে একটা মিশনে পড়ালাম ১০ মাস। সেই টাকায় আমার বি এড হলো। বি এড পরীক্ষা চলাকালীন মাদ্রাসার নোটিস হল । আমি তখন হরিয়ানায় বিএড করছি। আমাকে কুরিয়ার করে বই পাঠানো হল। বাড়ি এসে ১৫ দিন পর পরীক্ষা। পরীক্ষা দিলাম সেই মাদ্রাসায়। হলো বৈধতার প্রশ্নে কেস। তারপর ২০১৬ রেজাল্ট হলো। ২০১৭ ইন্টারভিউ দিলাম। ততদিনে আমি আপার প্রাইমারি (২০১৫), আর এসএসসি (২০১৬) এসএলএসটি পাশ করে যাই। আপার প্রাইমারি কেসের গেরোয় আটকে রইল। আমি ২০১৭ সালের ১৩ই নভেম্বর এসএলএসটি ইন্টারভিউ দিলাম। ২০১৭ জুলাই তাঁর আগে ডকুমেন্টস ভ্যারিফিকেশন হল। ২০১৮ রেজাল্ট হল আমি অপেক্ষা মানের তালিকায় ঠাঁই পেলাম। সেদিন  খুব কেঁদেছিলাম। তারপর মাদ্রাসার ফাইনাল প্যানেল বেরোলে আমি প্যানেলে ঠাই পেলাম না। বি এড ডিগ্রি তখন না থাকার জন্য।

বহু প্রতীক্ষার পর ২০১৯ শে ৫ই ফ্রেব্রুয়ারি দ্বিতীয় কাউন্সিলিং আমি এসএলএসটি ২০১৬ নাইন-টেনে চাকরিটাতে যোগ দিলাম। আজ সেই আমি বাড়ি থেকে ৭০০ কিমি দূরে পুরুলিয়ার একটি গ্ৰামে একজন শিক্ষিকা। শিক্ষিকা হওয়ার পর ২০২১ সালে আপার প্রাইমারি ভাইভা দিতে দেওয়া হয়নি ইন সার্ভিস বলে। এখন আমার একটাই পরিচয় আমি ২০১৬ এসএসসি প্যানেল ভূক্ত একজন যোগ্য শিক্ষিকা। আমাদের প্রায় ১৯০০০ যোগ্য শিক্ষক -শিক্ষিকাকে হাইকোর্ট, সুপ্রীম কোর্ট, সিবিআই, বাগ কমিটি কেউ কোন অভিযোগে অভিযুক্ত করেনি। আমার  মতো একমুঠো স্বপ্ন ছোঁয়ার পরেও যাদের তকমা দেওয়া হচ্ছে সমাজের ভিন্ন ভিন্ন শব্দচয়ন (কটুক্তি) করে নিজস্ব কর্মস্থল, মন্দির, মসজিদ, পাড়ার ঠেক, বাজার, পথে-ঘাটে। আমাদের একটাই অপরাধ আমরা কাউকে (দলের কোন নেতা) তোষামোদ করে, টাকা দিয়ে, অসাধু উপায়ে চাকরি (শিক্ষক-শিক্ষিকা)টা না পাওয়ার দল। অতি কষ্টে, দিনরাত এক করে নিজের যোগ্যতার নিরিখে পাওয়া যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকা। আমরা পরীক্ষা দিয়ে, সঠিক উপায়ে ভাইভা দিয়ে চাকরিটা পেয়েছি। ওএমআর রাখার দায় আমাদের নয়। হাইকোর্ট ২০২৪ শে ২২শে এপ্রিল প্রায় ২৬০০০ শিক্ষক/শিক্ষিকা, অশিক্ষক কর্মীদের প্যানেল বাতিল বলে গণ্য করে। এতে আমরা সিবিআই ও বাগ কমিটির  দেওয়া তথ্য অনুযায়ী প্রায় ১৯০০০ যোগ্য চাকরি হারা রয়েছি। নবম দশম প্রায় ৯২%, একাদশ -দ্বাদশ প্রায় ৮৬% যোগ্য শিক্ষক/শিক্ষিকা রয়েছি। আমরা এ ব্যাপারে একেবারে জ্ঞাত ছিলাম না যে এসএসসির ও পর্ষদের দুর্নীতির দায় আমাদের চলার পথকে কন্টকময় ও যন্ত্রণাদায়ক করে তুলবে। আমরা ৬/৭ বছর ধরে শিক্ষা ক্ষেত্রে পরিষেবা দিয়ে আসছি। ৯ বছর আগের একটি পরীক্ষা পদ্ধতি যতটা প্রস্তুতি নিয়ে দিতে পেরেছিলাম, সেটা আজ আর সম্ভব নয়। আমরা মানসিক ভাবে চরম বিপর্যস্ত। আমাদের সামাজিক সম্মান আজ প্রশ্ন চিহ্নের মুখে দাঁড়িয়ে। ২০২৫ শে ৩রা এপ্রিল এখন পুরো প্যানেল টাকে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করেছে। আমরা অনিশ্চিত জীবন কাটাচ্ছি। আমার ছেলে এখন ১৫ মাস বয়স। ওর দুধের বোতলটা পরের মাসে কিনতে পারবো কিনা আমার জানা নেই। আমার অসুস্থ প্রায় অন্ধ বাবার চিকিৎসা কি করে হবে আমার জানা নেই। আমার ছেলের ঔষধ কি করে কিনবো আমার জানা নেই। শুধুমাত্র জানি আমার প্রিয় ছাএীরা অধীর আগ্ৰহে আমাদের অপেক্ষা করে আছে। তারা বলত দিদিমনি আপনি কথা দিন আমরা মাধ্যমিক না দেওয়া পর্যন্ত আপনি কোথাও বদলি নেবেন না। এটা প্রত্যেকটি ব্যাচ এতদিন বলে এসেছে। আমরা কিভাবে বাঁচব জানা নেই। হয়ত এভাবেই আমরা শেষ হয়ে যাব।  যোগ্যরা শিক্ষিত নাগরিক সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, আমাদের মানসিক দিক থেকে সমর্থন করুন। মিডিয়া আমাদের নিয়ে সঠিক খবর পরিবেশন করুক। আমরা এবং আমাদের পরিবারের সকলকে বাঁচতে দিন। আশা রাখছি সঠিক বিচার আমরা পাবোই। আমাদের হারিয়ে যেতে দিবেন না, নয়তো শিক্ষা ব্যবস্থার কাঠামো অচিরেই হারিয়ে যাবে। আমরা বাঁচতে চাই, আমাদের বাঁচতে দিন।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

0 Comments

Post Comment