পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

উচ্চাকাঙ্খা, কমিউনিষ্ট পার্টি এবং এই সময় (প্রথম ভাগ)

  • 01 February, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 1460 view(s)
  • লিখেছেন : শংকর
কখনও দেখা যায়, এমন একটা বিতর্ককে হঠাৎই হেস্তনেস্ত করার ব্যাপার করে তোলা হল যা নিয়েই তিনি দীর্ঘদিন একসাথে চলছিলেন। এসবই খুব সূক্ষ্মভাবে করা হয়, ধাপে ধাপে উচ্চগ্রামে ওঠা হয়, এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয় যেখানে সাধারণ মতপার্থক্যগুলিও অসাধারণ হয়ে ওঠে এবং শেষ পর্যন্ত একসাথে চলাফেরাও অসম্ভব হয়ে যায়। আর এসবের ওপরে একটা কঠিন তাত্ত্বিক মতপার্থক্যের চাদর বিছানো থাকে। সর্বকালেই সর্বদেশে অন্যান্য রাজনৈতিক ধারার মত কমিউনিষ্ট আন্দোলনেও এই জিনিস দেখা গেছে। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু কেন এমন হয়?

লেনিনের মৃত্যুর পর রাশিয়ার পার্টিতে যে তীব্র অভ্যন্তরীণ সংগ্রাম শুরু হয় সে প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা এবং তৎকালীন কমিউনিষ্ট আন্তর্জাতিকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা কমরেড এম.এন.রায় বলেছিলেন যে, যে যে মতপার্থক্যগুলি নিয়ে জীবন-মরণ সংঘাত চলছে তার অনেকগুলিই বানানো, এবং কৃত্রিম যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। এই তর্কবিতর্কগুলির পেছনে আছে প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতা দখলের লড়াই, লেনিনের শূণ্যস্থান কে ভরাট করবে তার প্রতিযোগিতা। কমরেড রায় উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছিলেন যে, যে পলিসিগুলির পক্ষে ওকালতি করার কারণে বুখারিন, রাইকভের মত নেতাদের কোনঠাসা করা হয়েছে পার্টি কিন্তু সেই পলিসিগুলি নিয়েই চলছে। আগ্রহোদ্দীপক ব্যাপার হল, খুব কম কমিউনিষ্ট নেতাই এই স্পষ্টাচ্চারণ করার ক্ষমতা রাখেন। উচ্চাকাঙ্খা যে কমিউনিষ্ট রাজনীতির অভ্যন্তরীণ সংঘাতকে অনেক সময়েই নিয়ন্ত্রণ করেছে এ কথা খুব কম নেতাই স্বীকার করেন। সন্দেহ হয় যে, হয় তাঁরা নিজেদের বর্তমান কার্যকলাপকে ঢাকা দিতে চান অথবা ভবিষ্যতে নিজেদের জন্যে ঐ রাস্তায় যাবার সুযোগটা তাঁরা হয়ত হাতছাড়া করতে রাজি হন না। কিন্তু পার্টির কর্মীদের জিজ্ঞাসা করলে তাঁরা কিন্তু পরিষ্কার বলে দেবেন, আসল ব্যাপারটা কী! যদিও আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টা ধরতে পারা পার্টির নিত্যদিনের কাজকর্মের সাথে যুক্ত নন এমন লোকেদের পক্ষে বেশ কঠিন। কারণ, অভিজ্ঞ নেতারা কাঁচা কাজ করেন না। তাঁরা প্রায়শই বিষয়টিকে বেশ তাত্ত্বিক মোড়কে পেশ করেন। কখনও দেখা যায় এমন একটা বিতর্ককে হঠাৎই একেবারে জীবন-মরণের ব্যাপার করে তোলা হল যা দুদিন পরেও সমাধিত হলে ক্ষতি কিছু ছিল না। আবার কখনও দেখা যায়, এমন একটা বিতর্ককে হঠাৎই হেস্তনেস্ত করার ব্যাপার করে তোলা হল যা নিয়েই তিনি দীর্ঘদিন একসাথে চলছিলেন। এসবই খুব সূক্ষ্মভাবে করা হয়, ধাপে ধাপে উচ্চগ্রামে ওঠা হয়, এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয় যেখানে সাধারণ মতপার্থক্যগুলিও অসাধারণ হয়ে ওঠে এবং শেষ পর্যন্ত একসাথে চলাফেরাও অসম্ভব হয়ে যায়। আর এসবের ওপরে একটা কঠিন তাত্ত্বিক মতপার্থক্যের চাদর বিছানো থাকে। সর্বকালেই সর্বদেশে অন্যান্য রাজনৈতিক ধারার মত কমিউনিষ্ট আন্দোলনেও এই জিনিস দেখা গেছে। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু কেন এমন হয়? সমাজ বদলানোর প্রতিজ্ঞা নিয়ে যে কমিউনিষ্টরা অনেক আত্মত্যাগ করেন, বিপদকে তুচ্ছজ্ঞান করেন, তাঁরাও কেন শেষ পর্যন্ত শাসকশ্রেণির মতাদর্শে কলুষিত হয়ে যান? সমাজ বদলানোর লোকেরা কেন নিজেদের বদলাতে পারেন না? সমস্যাটা কোথায়?

 

সমস্যাটা আসলে খুবই জটিল, যার কোনো সহজ সমাধান নেই। কারণ সমস্যাটা নিজেকে নিয়ে, "আত্ম"কে নিয়ে। সমাজে এক ধরণের মানুষ দেখা যায় যাঁদের নিজেকে নিয়ে খুব বৃহৎ কিছু ভাবনা থাকে না। নিজেদের ব্যাপারে তাঁরা অল্পে সন্তুষ্ট। উচ্চাকাঙ্খা তাঁদের নেই। তাঁদের সমস্যা হল, বড় কোনো উদ্যোগ তাঁরা সাধারণত হাতে নেন না। খুব কম ক্ষেত্রেই তাঁরা ঝুঁকি নেন। সব পার্টির মত কমিউনিষ্ট পার্টিতেও এঁরা থাকেন, কাজ করেন। কিন্তু সাধারণত নেতৃত্ব দেবার ইচ্ছে এঁদের মধ্যে থাকে না। কিন্তু যাঁরা জীবনে ঝুঁকি নেন, বড় পরিকল্পনা করেন, এবং সেই পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার জন্যে উদ্যোগ নেন, তাঁরাই সাধারণত নেতৃত্বের জায়গায় উঠে আসেন। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, এই যে তাঁরা বড় ধরণের পরিকল্পনা করেন তা শুধুমাত্র তাঁদের লক্ষ্য বা মিশন নিয়েই নয়, নিজেকে নিয়েও। আর অধিকাংশ সময়েই নিজে লোকটি নিজের মিশনের থেকে বড় হয়ে দাঁড়ায়। আর যত এটা ঘটে ততই ব্যক্তির সঙ্গে কর্মের একটা বিযুক্তি ঘটে যায়। ব্যক্তি যত বড় হতে থাকে কর্ম তত ছোটো হতে থাকে। উপলক্ষ্য লক্ষ্যের থেকে বড় হয়ে দাঁড়ায় এবং এক সময়ে উপলক্ষ্যই লক্ষ্যের জায়গা নিয়ে নেয়। এর অবধারিত ফলাফল হল পার্টির মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হওয়া, টেনশন তৈরি হওয়া এবং তীব্র মনোমালিন্য তৈরি হওয়া, যার পরিণতিতে পার্টি ভাঙনও ঘটে।

 

একটা সময় ছিল যখন কমিউনিষ্ট পার্টি নৈতিকতার উপর জোর দিত। কারণ, এটা মনে করা হত যে, কমিউনিষ্ট কর্মীদের যদি নীতি-নৈতিকতা না থাকে তাহলে যত বড় সাফল্যই তাঁরা অর্জন করুন না কেন তা হবে ফাঁপা, ক্ষণস্থায়ী এবং আপাত। তা সাফল্যের থেকে অনেক বেশি করে ডেকে আনবে ব্যর্থতা। এবং সাফল্য হয়ে দাঁড়াবে ঔদ্ধত্যের কারণ যা অংশকে সমগ্রের তুলনায়, ব্যক্তিকে সংগঠনের তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করার মানসিকতা তৈরি করবে। বড় কাজ হাতে নেবার অর্থ নিজেকে বাড়িয়ে ভাবা নয়, খ্যাতি-পদ-মাতিব্বরির লোভ নয়। ১৯৪২ সালে মাও সে তুং "পার্টির কর্মপদ্ধতি সংশোধন করুন", নামে একটি লেখা লিখেছিলেন। তাতে তিনি মন্তব্য করেন,

 

"কিছু কমরেড শুধু অংশেরই স্বার্থ দেখেন, সমগ্রের স্বার্থ দেখেন না; তাদের ওপর কাজের যে অংশের দায়িত্ব, শুধু সেটারই গুরুত্ব তারা অহেতুক আরোপ করেন, এবং সমগ্র কাজটির স্বার্থকে তাঁরা নিজের অংশের কাজের স্বার্থের অধীন করে রাখতে ইচ্ছুক। তাঁরা পার্টির অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা বোঝেন না এবং এ কথা উপলব্ধি করেন না যে কমিউনিষ্ট পার্টির পক্ষে গণতন্ত্রই শুধু প্রয়োজন নয়, বরং কেন্দ্রিকতাও প্রয়োজন এবং তা প্রয়োজন আরও বেশি করে।……  যাঁরা স্বাতন্ত্র‍্য ঘোষণা করেন, তাঁরা প্রায়শই এই কথা বলেন যে ব্যক্তির স্থান সর্বাগ্রে এবং পার্টি ও ব্যক্তির মাঝে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাঁরা প্রায়ই ভুল করেন। যদিও তাঁরা পার্টির প্রতি মৌখিক শ্রদ্ধা নিবেদন করেন, প্রকৃতপক্ষে তারা নিজেদের স্থাপন করেন প্রথমে এবং পার্টির স্বার্থকে স্থান দেন তারপর। কমরেড লিউ শাও চি একবার কিছু ব্যক্তি সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন যে, তাদের হাতগুলো হল অস্বাভাবিক লম্বা এবং সব কিছুকেই নিজেদের স্বার্থের অনুকূল করে ফেলতে তারা সিদ্ধহস্ত, অন্যের স্বার্থ বা সমগ্র পার্টির স্বার্থের প্রতি তাদের খুবই কম বিবেচনা।……  তারা কিসের পেছনে ছুটছেন? তাদের লক্ষ্য হল খ্যাতি, পদ এবং তাদের অভিলাষ হল মর্যাদাসম্পন্ন চালচলন অর্জন করা। এই উদ্দেশ্যে তারা কিছুকে তুষ্ট করেন, কিছুকে অপবাদ দিয়ে বর্জন করেন, দম্ভ তোষামোদ দালালি –--- এসবের আশ্রয় গ্রহণ করেন; এককথায় কমিউনিষ্ট পার্টিতে তারা প্রবর্তন করেন বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলির রীতিসুলভ চালচলন। তাদের অসততাই তাদের কাল হয়ে দাঁড়ায়। আমার মনে হয়, আমাদের কাজকর্ম সৎ এবং সোজাসুজি হওয়া উচিত; সততা ছাড়া এ জগতে কোনো কিছুই করা যায় না।"

 

এখানে মাওয়ের বক্তব্যে আমরা যে নৈতিক দার্শনিকতার সন্ধান পাই তা কমিউনিষ্ট আন্দোলনে এক সময়ে বারংবার আলোচিত হত। কিন্তু আজকের সময়টা অন্য রকম। আজ দুনিয়া জুড়েই কমিউনিষ্ট আন্দোলন অনেকটা পিছু হঠেছে, ছত্রখান হয়েছে, বহু টুকরোতে বিভাজিত হয়েছে। ফলে আপাত সাফল্যই অনেক বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। কর্মকুশল নেতাদের গুরুত্ব অনেক বেড়ে গিয়েছে। এদিক ওদিক সাংগঠনিক বিস্তারের মাহাত্ম্য এমনই বড় হয়ে উঠেছে যে করিৎকর্মা নেতাদের নৈতিক তথা আদর্শনৈতিক বিচ্যুতি নিয়ে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করা অবিবেচনার কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মার্কসবাদী দার্শনিক ভিত্তির বদলে আপাত সাফল্যমন্ডিত পার্টি প্রকৃতপক্ষে নয়া-উদারবাদী দার্শনিক ভিত্তির উপরে নিজেকে স্থাপিত করে ফেলছে। বর্তমান পরিস্থিতির এই দুটি দিক –------ কমিউনিষ্ট আন্দোলনের বর্তমান করুন অবস্থা এবং নয়া উদারবাদী দর্শনের প্রচন্ড প্রভাব, আজকের অবস্থাকে অত্যন্ত জটিল করে তুলেছে এবং দুটি দিক পারষ্পরিক প্রভাব বিস্তারের মধ্যে দিয়ে একটি শক্তিশালী গ্রন্থিতে পরিণত হয়েছে।

 

উপরোক্ত দুইটি বিষয়ের মধ্যে কমিউনিষ্ট আন্দোলনের করুণ, ছত্রভঙ্গ অবস্থার সঙ্গে কমিউনিষ্ট আন্দোলন থেকে নৈতিক-দর্শনের বিদায় নেবার সম্পর্কটি নিয়ে তাও কিছু কথাবার্তা লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু নয়া উদারবাদী দর্শনের প্রভাব কীভাবে এই ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটিয়ে চলেছে তা নিয়ে খুব একটা কথাবার্তা কিন্তু লক্ষ্য করা যায় না। সুতরাং, এই বিষয়টি নিয়ে কমিউনিষ্ট কর্মীদের বিশেষভাবে মনোনিবেশ করতে হবে। নয়া উদারবাদী দর্শনের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হল, মাও যাকে বলেছেন, অংশের স্বার্থকে সমগ্রের স্বার্থের উপরে স্থান দেওয়া। যদিও মাও যখন উক্ত লেখাটি লিখেছিলেন তখন নয়া উদারবাদ প্রবর্তিত হয় নি। তাই দেখা যাবে রোগটি থাকলেও তা আজকের মতো মহামারীর চেহারা নেয় নি। কিন্তু আজকে একেবারে তত্ত্বায়ন করে বিষয়টিকে দাঁড় করানো হচ্ছে, এবং কমিউনিষ্ট আন্দোলনও প্রবলভাবে এই পাঁকে দূষিত হচ্ছে। যদিও মুখে এবং লেখায় রীতিপদ্ধতি মেনে বলা হচ্ছে সেই চিরাচরিত কথাগুলোই। কিন্তু কাজে এবং মানসিকতায় সমগ্র নয়, অংশই প্রধান হয়ে দেখা দিয়েছে।

 

অংশ এবং সমগ্র এই দুটি শব্দকে সাধারণীকৃত দার্শনিক শব্দ হিসাবে প্রয়োগ করা হয়। সুতরাং, এই দুটি ধারণা বিভিন্ন বিমূর্ততায় নিজেদের প্রকাশ করে, যেমন, বর্তমানের কাজের সঙ্গে সমগ্র কাজের সম্পর্ক, একটি স্থানের কাজের সঙ্গে সমগ্র কাজের সম্পর্ক, একটি কমিটির কাজের সঙ্গে সমগ্র পার্টির কাজের সম্পর্ক, একটি পার্টির স্বার্থের সঙ্গে সমগ্র আন্দোলনের স্বার্থের সম্পর্ক, ব্যক্তির সাথে যৌথের সম্পর্ক, ইত্যাদি। নয়া উদারবাদী দর্শন সদাসর্বদা অংশের প্রাধান্যকেই সব থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে দাঁড় করায়। নয়া উদারবাদে কলুষিত কমিউনিষ্ট আন্দোলন এর মধ্যে সব থেকে বেশি কলুষিত হয়েছে ব্যক্তি ও যৌথের সম্পর্কের ক্ষেত্রে। এক একজন ব্যক্তি এক একটি যৌথে এমন এক একটি "সম্পদ" (asset)- এ পরিণত হয়েছেন বলে ভেবে নিচ্ছেন যে, তিনিই যেন গোটা যৌথকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। কমিউনিষ্ট আন্দোলনের বর্তমান হতশ্রী অবস্থার কারণে যৌথগুলি আবার এতটাই ছোট হয়ে গিয়েছে যে, যৌথের ওপর ব্যক্তির প্রাধান্য তৈরি হবার বিষয়গত পরিস্থিতিও অত্যন্ত অনুকূল অবস্থায় রয়েছে। এর ফলে আবার একটি "চিত্তাকর্ষক" পরিস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রাধান্য অভিলাষী "সম্পদ" নেতারাও যেহেতু আন্দোলনের এই হতশ্রী অবস্থার "গুরুত্ব" বোঝেন, টুকরো হয়ে থাকার "হিতকারী" প্রভাবটি বোঝেন, তাই এঁদের কাছে ঐক্যের সমস্ত কথাই আসলে কৌশলগত, ট্যাকটিকাল। ফাঁপা কথা। পরিষ্কার ভন্ডামি। ফলে "ঐক্য ঐক্য" বলে চীৎকারই শুধু হয়, ঐক্য হয় না। আর হলেও তা আসলে ব্যক্তির ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্খা পূরণের হাতিয়ার হিসাবে দেখা হয়। ফলে অর্জিত ঐক্যও ভঙ্গুর এবং ক্ষণস্থায়ী হয়। কমিউনিষ্ট আন্দোলনের হতশ্রী অবস্থা যতদিন বিরাজ করবে ততদিন এই "সম্পদ" নেতাদের মৌরসীপাট্টাও বজায় থাকবে। আবার এই মৌরসীপাট্টা যতদিন বজায় থাকবে কমিউনিষ্ট আন্দোলনের পক্ষে হতমান অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসাও সম্ভব হবে না।

 

এইখানে আমাদের বিষয়টির জটিলতর একটি দিকের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে হবে। নেতারা ভুল করেন, আত্মম্ভরিতায় ভোগেন, যে লক্ষ্যে তাঁদের কাজ করার কথা তার থেকেও তাঁর নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, ফলত তাঁরা অনুগত কর্মীবাহিনী তৈরি করতে চান, এসবই ঠিক। কিন্তু বাস্তব রাজনীতিতে এঁদেরই "বাজারদর" অনেক বেশি হয় কেন? কেনই বা এঁদের কর্মীবাহিনীও ঠিকই জুটে যায়। এঁরা যখন আনুগত্যের বিনিময়ে গুরুত্ব বিলি করে বেরান কেন তখন তা হাত পেতে নেবার লোকও ঠিকই জুটে যায়? কেন উল্টোটা হয় না? কেন তাঁর বিচ্যুতিগুলি কর্মীবাহিনীর সমালোচনার বিষয় হয়ে ওঠে না? যদি সত্যিই তাঁদের বিচ্যুতিগুলি বিচ্যুতি হয়ে থাকে তাহলে কেন তা সংগঠনে প্রতিহত হয় না? এটি একটি গভীরতর সংকটের দিক। আমাদের বর্তমান রাজনীতির ক্ষুদ্র পরিসরেই শুধু এটি তাৎপর্যসম্পন্ন এমন নয়, আন্তর্জাতিক কমিউনিষ্ট আন্দোলনের সংকটের ক্ষেত্রেও এই প্রশ্নটির অশেষ তাৎপর্য আছে। যেমন ধরুন, আমরা অনেকেই এভাবে বলি, রাশিয়ার পার্টির বিংশতিতম কংগ্রেসে স্তালিনকে নস্যাৎ করে ক্রুশ্চেভ পার্টিতে ক্ষমতাদখল করেন এবং রাশিয়ার পার্টির সংশোধনবাদের দিকে যাত্রা শুরু হয়। এর ফল স্বরূপ রাশিয়া ও চিনের পার্টির মধ্যে মহাবিতর্ক শুরু হয়, ইত্যাদি। এখন প্রশ্ন হল রাশিয়ার পার্টির বিংশতিতম কংগ্রেসে ক্রুশ্চেভ নির্বাচিত হলেন কীভাবে? এবং তারও পরে দীর্ঘদিন ধরে থাকলেন কীকরে এবং তারপর সেই একই লাইনে একের পর এক নেতারা পার্টিকে বলশেভিকবাদের লাইন থেকে সংশোধনবাদ, সামাজিক-সাম্রাজ্যবাদ এবং পরিশেষে গোটা ব্যবস্থারই পতন –--- এই জায়গা পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারলেন কীকরে? পার্টি কর্মীরা কী করছিলেন? দীর্ঘদিনের পোড় খাওয়া পার্টি এবং সর্বোপরি রাশিয়ার "সমাজতান্ত্রিক জনগণ" এটা কীভাবে হতে দিলেন? একজন দুজন নেতা যা চাইবেন তা-ই তাঁরা করে যেতে পারবেন, বিষয়টা কি এতটাই সোজা?

 

না, এতটা সোজা নয়। এর পেছনে কিছু বস্তুগত কারণ আছে। আসলে জনগণ চায় 'নেতা'। সেইজন্যেই সে 'জনগণ'। উল্টোদিকে 'নেতা'ও চায় 'জনগণ'। সেইজন্যেই সে 'নেতা'। 'নেতা' আর 'জনগণ', 'নেতা' এবং 'ক্যাডার' এইগুলি একই সমগ্রের দুইটি দিক। একটা শ্রেণিবিভক্ত সমাজ যে বস্তুগত পরিস্থিতি তৈরি করে তাতে স্বাভাবিকভাবেই এই দুই বিপরীতের উদ্ভব হয়। ফলে তৈরি হয় এমন এক একজন লোক যাঁরা ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে আসে, নেতৃত্ব দেয়, লোকে তাঁকে মান্যতা দেয়, জনগণের আপাত নিষ্ক্রিয়তা এবং নেতার আপাত সক্রিয়তা একদিকে তৈরি করে উচ্চাকাঙ্খার বস্তুগত পরিস্থিতি এবং অন্যপ্রান্তে একই নিয়মে তৈরি করে সেই উচ্চাকাঙ্খাকে মেনে নেবারও বস্তুগত পরিস্থিতি। একজন "শ্রদ্ধেয় নেতা", "অন্তরের নেতা", "বিপ্লবী আন্দোলনের অথরিটি" তৈরি হবার মানেই হল উল্টোদিকে বহু সংখ্যক মস্তিষ্কহীন, উদ্যোগহীন অনুগত কর্মীবাহিনীরও তৈরি হওয়া।

 

এইরকম একটা পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে একটা কমিউনিষ্ট পার্টি দুভাবে বিষয়টাকে নাড়াচাড়া করতে পারে। এক, এই পরিস্থিতিকে অটুট রেখেই তার মধ্যেই সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্টভাবে বিপ্লবী রাজনীতিকে প্রয়োগ করার চেষ্টা করা। অথবা, দুই, পরিস্থিতিটিকেই পরিবর্তনের জন্যে সচেতন উদ্যোগ নেওয়া। অর্থাৎ, নেতা-ক্যাডার, নেতা-জনগণ এই দ্বিত্তকে ভাঙ্গার কাজটিকে সচেতনভাবে হাতে নেওয়া এবং সেই প্রেক্ষিতেই, একমাত্র সেই প্রেক্ষিতেই বিপ্লবী রাজনীতিকে প্রয়োগ করা। এইজন্যেই হীনযানপন্থী বৌদ্ধদের সমালোচনা করে মহাযানমতের কেউ কেউ বলেছিলেন, জীবনের সকল উচ্চাকাঙ্খা পরিত্যাগ করে নির্বাণের পেছনে ছুটে যাওয়াও আসলে উচ্চাকাঙ্ক্ষার আরও একটি রূপ।

 

বিষয়টিকে সামান্য ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। যদি পার্টি প্রথম রাস্তায় চলে, অর্থাৎ, নেতা-জনগণ দ্বিত্তের বিদ্যমান পরিস্থিতিকে বজায় রেখেই সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্টভাবে বিপ্লবী রাজনীতিকে প্রয়োগ করতে চায় তাহলে তাকে কী করতে হবে? সে সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট কোনটা করতে পারে? মাওয়ের যে বক্তব্যটি উদ্ধৃত করেছি সেখানে মাও তা চিহ্নিত করে দিয়েছেন। মার্কসীয় দর্শনকে তার নৈতিক-দার্শনিক চেহারায় বুঝতে হবে এবং প্রয়োগ করতে হবে। "লম্বা হাতওয়ালা" নেতাদের প্রতিহত করতে হবে। আমরা এটা আলোচনা করেছি যে, আজকের দিনে মাওয়ের এই সাবধানবাণী ও দিকনির্দেশ থেকে যতদূরে যাওয়া হচ্ছে ততই সমস্যা বাড়ছে। কিন্তু সমস্যা হল, অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে এমনকি মাওয়ের সময়েও, বিপ্লবের আগে এবং পরে, পার্টিতে "লম্বা হাতওয়ালা" নেতাদের উদ্ভব কখনই ঠেকানো যায় নি। বন্যার স্রোতের মত তাঁরা এসেছেন এবং সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে চলে গেছেন। লোকে তাঁদের মান্যতাও দিয়েছে এবং জীবনের শেষে এসে চৌ এন লাই-এর উদ্যেশ্যে মাওয়ের কবিতায় তাঁকে বলতে হয়েছে, "আমাদের যত অপূর্ণ ব্রত হয়তো হাজার বছরে পাবে পূর্ণতা/ ক্লান্ত করছে সংগ্রাম আর আজ আমাদের শুভ্রকেশ/ আমাদের সমস্ত প্রয়াস প্লাবনে যদিই বা ধুয়ে মুছে/ তুমি আর আমি পুরাতন সখা/ আমরা কি পারি শুধু নিঃসাড়ে দেখে যেতে?"

 

আসলে, কমিউনিষ্ট পার্টিকে মার্কসীয় দর্শনকে তার নৈতিক-দার্শনিক ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে হবে, এটি একেবারেই নিশ্চিত। এটি অপরিহার্য। কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। মার্কসীয় দ্বন্দ্ববাদী দর্শনের বৈপ্লবিক গভীরতাকে আরও বিস্তৃত করতে হবে। নেতা-কর্মী দ্বিত্তকে, নেতা-জনগণ দ্বিত্তকে সজোরে ভাঙ্গার কাজটিকে কেন্দ্র করেই তাকে তার বিপ্লবী রাজনীতিকে প্রয়োগ করতে হবে। মার্কস "ফয়েরবাখ সম্পর্কে এগারোটি থিসিস" -এর তিন নম্বর থিসিসে এটাই বলেছিলেন। মার্কসের কথা প্রণিধানযোগ্যঃ "মানুষ পরিবেশ এবং পরিপালনের ফল, অতএব পরিবর্তিত মানুষ হল অন্য পরিবেশ এবং পরিবর্তিত পরিপালনের ফল, এই বস্তুবাদী মতবাদ ভুলে যায় যে, মানুষই পরিবেশকে পরিবর্তিত করে, এবং স্বয়ং পরিপালককেই পরিপালন করা প্রয়োজন।" অর্থাৎ, যে পরিবেশ মানুষের পরিপালক হিসাবে কাজ করে তাকেই আবার পরিপালন করে মানুষ। এই যে, পরিপালকের পরিপালন করা, অর্থাৎ পরিস্থিতিকে পালটে নেওয়া, তাকে গড়েপিঠে নেওয়া, এইটিই হল মানুষের বৈপ্লবিক কর্মকান্ড। শুধুমাত্র বিদ্যমান পরিস্থিতিতের মধ্যেই সর্বোত্তম কাজটি হাসিল করার চেষ্টা করাটা নিজেই বিপ্লবী রাজনীতি বলে গণ্য হতে পারে না। পরিপালকের পরিপালন হাতে নেওয়া অপরিহার্য। যে বস্তুগত অবস্থা নেতা-জনগণ দ্বিত্ত, নেতা-ক্যাডার দ্বিত্ত তৈরি করে তাকে পাল্টানোর সচেতন প্রয়াস ছাড়া তাই আজকের দিনে আর বিপ্লবী কমিউনিষ্ট পার্টি গড়ে তোলা যাবে না।

 

কমিউনিষ্ট আন্দোলনে স্বাতন্ত্র্যবাদে ভোগা নেতৃত্বের এই দীর্ঘকালীন মৌরসীপাট্টার প্রভাবে কমিউনিষ্ট পার্টিগুলিতে একনিষ্ঠ কর্মীবাহিনী গড়ে তোলাও মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। নয়া উদারবাদের যুগে এমনকি কমিউনিষ্ট পার্টিতে কাজ করাটাও এক প্রকার "কেরিয়ারিসম্" হয়ে দাঁড়াচ্ছে। উচ্চাভিলাষী নেতৃবর্গকে দেখে যে কর্মীবাহিনী তৈরি হচ্ছে তাঁদের কাছেও পার্টির কাজ "কেরিয়ার করা"র থেকে আলাদা কিছু দাঁড়াচ্ছে না। একটা সময় ছিল যখন কেরিয়ার করা আর না করার মধ্যে একটা স্পষ্ট এবং দৃশ্যমান সীমারেখা ছিল। আজকের সময়ে বিষয়টা আর এত সহজ নয়। কমিউনিষ্ট পার্টিগুলির অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতৃবর্গের মধ্যে যাঁদেরই একটু নামডাক হয়ে যাচ্ছে তাঁদেরই পার্টিতে ধরে রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। মূলধারার কমিউনিষ্ট পার্টিগুলির ঝাঁ চকচকে তরুন নেতারা তৃণমূল কংগ্রেসে চলে গেছেন, কংগ্রেসে চলে গেছেন এটা আমরা দেখেছি। বিপ্লবী পার্টিগুলির অবস্থাও ভালো নয়। আর যাঁরা পার্টিতে থাকছেনও তাঁরাও অনেকক্ষেত্রে নির্ভীক, মেরুদন্ডসম্পন্ন এবং স্বাধীন কমিউনিষ্ট চিন্তক হিসাবে গড়ে উঠতে ব্যর্থ হচ্ছেন। তাঁরাও বিভিন্ন প্রকারের পার্টি-ম্যানিপুলেশনে জড়িয়ে পড়ছেন এবং পার্টিতে "গুরুত্ব" পাওয়াটাকেই জীবনের অন্যতম প্রাপ্তি হিসাবে ধরে নিচ্ছেন। প্রক্রিয়াটা শুরু হচ্ছে উপর থেকে। "সম্পদ" নেতারা সর্বদাই তৈরি করতে চান অনুগত ক্যাডারবাহিনী। সুতরাং, তাঁরা আনুগত্যের বিনিময়ে পুরষ্কারস্বরূপ "গুরুত্ব" বিলি করে বেরান।

 

১৯৩৭ সালে লেখা মাওয়ের আরও একটি লেখা এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন। Combat Liberalism (উদারতাবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম কর) শীর্ষক লেখাতে মাও উদারতাবাদের অনেকগুলি প্রকাশকে চিহ্নিত করেছিলেন। তার মধ্যে প্রথমেই যেটির কথা বলেন সেটি নিম্নরূপঃ

 

To let things slide for the sake of peace and friendship when a person has clearly gone wrong, and refrain from principled argument because he is an old acquaintance, a fellow townsman, a schoolmate, a close friend, a loved one, an old colleague or old subordinate. Or to touch on the matter lightly instead of going into it thoroughly, so as to keep on good terms. The result is that both the organization and the individual are harmed. This is one type of liberalism.

 

(যখন কোনো ব্যক্তি পরিষ্কারভাবে ভুল পথে যাচ্ছেন তখন শান্তি এবং বন্ধুত্ব বজায় রাখার জন্যে তা না দেখার ভান করা কারণ তিনি অনেকদিনের পরিচিত, একই শহরের লোক, স্কুলের সহপাঠী, ঘনিষ্ঠ বন্ধু, ভালোবাসার লোক, পুরনো সহকর্মী অথবা পুরনো কর্মী। অথবা, বিষয়টির গভীরে যাবার বদলে হালকা চালে স্পর্ষ করা হয়, যাতে করে ভালো সম্পর্ক বজায় থাকে। এর ফলে ব্যক্তি এবং সংগঠন উভয়ই ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এটি উদারতাবাদের একটি ধরণ।)

 

এর অবধারিত ফলাফল হল, পার্টিকর্মীদের মধ্যে এই ধারনা তৈরি হয় যে, কোনো এক নেতার অনুগত থাকলে বা কোনো এক নেতাকে অনৈতিকভাবে হলেও সমর্থন জুগিয়ে চললে, তার পক্ষে হাত তুললে, তার গভীর অপকর্মগুলিকে যুক্তি দ্বারা সিদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে গেলে পুরষ্কারস্বরূপ "গুরুত্ব" লাভ সম্ভব। আর উল্টোদিকে সত্যনিষ্ঠ, নির্ভীক এবং নৈতিক-দার্শনিক অবস্থান থেকে রাজনীতি করতে গেলে রাস্তা অনেক বন্ধুর হবে। ফলে অনুগত হয়ে উঠার প্রবণতা শক্তিশালী হতে থাকে। একজন কমিউনিষ্ট কর্মীও কেরিয়ারিস্ট হতে পারেন। একজন পার্টিকর্মীও কেরিয়ারিস্ট হতে পারেন। একে "পার্টি কেরিয়ারিসম" বলা যেতে পারে। নয়া উদারবাদের জমানায় এটি একটি গভীর রোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অংশের স্বার্থকে সমগ্র স্বার্থের উর্দ্ধে স্থান দেওয়া, ব্যক্তির স্বার্থকে যৌথের স্বার্থের উর্দ্ধে স্থান দেওয়া আজ নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যক্তি ও সমষ্টির সম্পর্কটিকে আজ পর্যন্ত যেভাবে কমিউনিষ্ট পার্টিতে বুঝে ওঠা হয়েছে তার সীমাবদ্ধতাই আসলে আজকের এই পরিস্থিতির জন্যে দায়ী। এই বিষয়ে আমরা এই লেখার দ্বিতীয় ভাগে আলোচনা করব।

 

বর্তমান পরিস্থিতির অন্য একটি উপাদান গোটা সমস্যাটিকে আরও অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং করে তুলছে। আজকের যুগ তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। ফলে ঘটনার দৃশ্যমানতা অনেক বেশি সুলভ। আজকের দিনে যত সহজে ছবি, লেখা, ভিডিও ব্যাপক জনতার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া যায় তা অতীতে সম্ভব ছিল না। তথ্যের এই গতিময়তা কমিউনিষ্ট পার্টির কাছে একদিকে যেমন নতুন নতুন সুযোগ তৈরি করেছে, তেমনই তার মধ্যে ইতিমধ্যে থাকা দার্শনিক সংকটকে গভীরতর করে তুলেছে। ব্যক্তি অতি সহজেই আজ দৃশ্যমান। সুতরাং, ব্যক্তির ভূমিকা আজকের দিনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ফলে ব্যক্তি ও যৌথের মধ্যেকার সম্পর্ককে অনেক জোরের সঙ্গে আজকের দিনে মার্কসীয় দার্শনিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি একটি দার্শনিক কাজ, যা ছাড়া আজকের দিনে কমিউনিষ্ট পার্টি এগুতে পারবে না। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে এই চ্যালেঞ্জটি হাতে নিতে অক্ষম সংগঠনগুলি তার ক্ষতিগ্রস্ত দার্শনিক ভিত্তিকে জোরের সঙ্গে মেরামতি করার বদলে সহজ রাস্তা হিসাবে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার থেকেই দূরে থাকার পক্ষে কথা বলছে, এমনকি তাকে তত্ত্বায়নও করছে। বালিতে মুখ গুঁজে যেমন ঝড়ের হাত থেকে বাঁচা যায় না, তেমনই এই রাস্তা ব্যর্থ হতে বাধ্য।

 

সুতরাং, আজকের দিনে, অর্থাৎ এই নয়া উদারবাদের যুগে, শক্তিশালী কমিউনিষ্ট পার্টি এবং কমিউনিষ্ট আন্দোলন অতীতের মত শুধুমাত্র সঠিক "পার্টি লাইন"-এর নির্ভর করে আর গড়ে তোলা যাবে না। সে যুগ শেষ হয়ে গেছে। একথা পরিষ্কার বুঝে নিতে হবে। কমিউনিষ্ট আন্দোলনকে পুনরুজ্জীবিত করতে গেলে সঠিক লাইন অপরিহার্য বটে, কিন্তু তা আর যথেষ্ট নয়। সঠিক লাইনের পাশাপাশি চাই সঠিক সাংস্কৃতিক-দার্শনিক ভিত্তি। যাঁরা সমগ্র সময়ের তুলনায় মুহুর্তের দাবিকে অগ্রাধিকার দেবেন, যৌথের তুলনায় ব্যক্তির গুরুত্বকে বাড়িয়ে দেখবেন, সমগ্রের তুলনায় অংশকে আঁকড়ে থাকবেন তাঁদের দৃষ্টির দিকচক্রবাল সংকুচিত হতে হতে গোড়ালিতে ঠেকতে বাধ্য। তাঁরা আজকের দিনে কমিউনিষ্ট আন্দোলনে সামান্য ভূমিকাও রাখতে পারবেন না। আপনার সাফল্য ঠিক ততটাই বড় হবে, যতটা বড় আপনার যৌথ সংস্কৃতি, যতটা দৃঢ় সে যৌথের বিপ্লবী দার্শনিক ভিত্তি। বাকি সবই আদানির পুঁজির মতই বুদবুদ্। 

 

 

 

 

0 Comments

Post Comment