পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh


পড়শি যদি আমায় ছুঁতো

যম যাতনা সকল যেত দূরে

—ফকির লালন সাঁই

পড়শিকে ছুঁতে চাওয়া লালন সাঁইয়ের  আর্তি প্রায় দুশো বছর পরেও আমাদের। গায়ে গা লাগিয়ে বাস করা পড়শি বরং আরও দুরের হয়েছে। না-চেনা বেড়েছে বৈ কমেনি। সে আমাদেরই পাপে। তার ফলে বেড়েছে অজ্ঞতা ফলে অবিশ্বাস। তার থেকে জন্ম নিয়েছে বৈরিতা। ধর্মীয় মৌলবাদ আর রাষ্ট্রীয় ফ্যাসিবাদ ছোবল মারছে। প্রতিরোধে প্রতিবাদে পড়শিকে আজ থাকতে হবে আরও বেঁধে বেঁধে। বৈরিতা মুছে ফেলে সহজ সমাজের দিকে পৌঁছনোর এক বিনীত প্রয়াস, ‘সহমন’।

ধর্মের মুখোশ পরে ফ্যাসিবাদ আমাদের ঘাড়ের ওপর চেপে বসছে। খাওয়া পরা কথা বলা—­­ যে কোনও অধিকারই আজ বিপন্ন। তারা ধর্মকে করেছে রাজনীতির হাতিয়ার। 

দেশের মানুষকে ধর্ম আর জাতপাতে ভাগ করে দিচ্ছে। তাদের মগজে সব সময় বিভেদের চিন্তা ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যাতে রুটি রুজি স্বাস্থ্য শিক্ষা ইত্যাদি মৌলিক সমস্যাগুলোকে নিয়ে তারা ভাবতেই না পারে। একই ভাবে তাদের ভাগ করে দিয়ে নিজেদের মধ্যেই লড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে যাতে সাধারণ মানুষ তাদের অধিকারের জন্য জোট বেঁধে লড়াই করতে না পারে। শাসকেরাই ধর্মের গুরুঠাকুর সেজে সাধারণ মানুষকে তাদের যে কোনও নীতি বা কাজ সম্পর্কে প্রশ্ন তোলাকে দেশদ্রোহিতা বলে দেগে দিচ্ছে। 

ফ্যাসিবাদ তাদের দর্শন। ফ্যাসিবাদ হল একটা চরমপন্থী, জাতীয়তাবাদী, কর্তৃত্বপরায়ন রাজনৈতিক  মতাদর্শ। এই দর্শন সবকিছুকেই রাষ্ট্রের নামে নিজেদের অধীন বলে মনে করে। রাষ্ট্র হচ্ছে বর্ম, নেপথ্যে থাকে একটি সর্বগ্রাসী দল বা গোষ্ঠী, ফ্যাসিবাদ তাদের আদর্শ। ফ্যাসিবাদে রাষ্ট্রের গুরুত্বের ওপর জোর দেওয়া হয়। ফ্যাসিবাদ গণতান্ত্রিক পদ্ধতি-প্রকরণের বিরোধী। 

মানুষের সব রকম বিকাশকে রুদ্ধ করে ফ্যাসিবাদ। কিন্তু ফ্যাসিবাদের চরিত্র, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং কীভাবে ফ্যাসিবাদ রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বত্র বিরাজ করে তা সঠিকভাবে অনুধাবন করতে না পারলে ফ্যাসিবাদবিরোধী প্রতিরোধ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। সমাজ ও ব্যক্তি পরিসরে গভীরভাবে প্রোথিত থাকে ফ্যাসিবাদের শর্ত ও বীজ। ফ্যাসিবাদ হল একটি কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাকাঠামো দ্বারা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনকে চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণের মতবাদ। অথচ ফ্যাসিবাদের বৈধতা আসে চেতন কিংবা অবচেতনভাবে জনগণের কাছ থেকেই। ফলে, একটি চূড়ান্ত ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থায় দমন-পীড়ণ-নিপীড়ণ-শোষণে সর্বসাধারণের জীবন অতিষ্ঠ হলেও ঠিক কী উপায়ে আন্দোলন সংগঠিত করে তার বিরুদ্ধ লড়াই করার শক্তি অর্জন সম্ভব সেই ব্যাপারে জনগণ প্রায়শই বিভ্রান্ত হয়। 

এই বিভ্রান্তির ফাঁদে পড়েছে ভারতের সাধারণ মানুষ। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ এবং তার রাজনৈতিক শাগরেদ ভারতীয় জনতা পার্টি আজ তেমনই এক ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা কায়েম করতে চাইছে। সংঘ পরিবার দেশব্যাপী হিন্দুত্বের যে জাল ছড়িয়েছে তাতে ধরা পড়ছে শিক্ষিত অশিক্ষিত ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষ। ফ্যাসিবাদী ওই শক্তি কিন্তু তাদের ব্রত পালনে অনেকটাই সফল। রাজ্যে রাজ্যে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের কাজ প্রায় সম্পন্ন করে ফেলেছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রায় প্রতিদিন মুসলিম আর দলিতদের ওপর ছুতোনাতায় যে ভাবে আক্রমণ-অত্যাচার হচ্ছে, তা দিয়ে বোঝা যায় দেশে সাম্প্রদায়িক বিভেদ কোন স্তরে পৌঁছেছে। রাজনৈতিক দলগুলো মুখে অনেক কথা বললেও সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদীদের মোকাবিলায় সক্রিয় নয়।

ফ্যাসিবাদের আরেক অস্ত্র মিথ্যা প্রচার। কিছু মিথ্যাকে ক্রমাগত কানের কাছে বলতে থাকলে এক সময় সেগুলো সত্যি বলে ভ্রান্তি হয়। সংঘ পরিবার এবং বিজেপি মিথ্যা প্রচার শুরু করেছে গঠিত ভাবে এবং পেশাদারি কায়দায়।

ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার, টিভি, খবরের কাগজ এমনকি সিনেমাকেও তারা মিথ্যা প্রচারের 

মাধ্যম করেছে। তৈরি করেছে সাইবার সেল। তার জন্য তারা খরচ করছে বিপুল অর্থ। সাধ্য মতো ওই মিথ্যার জবাব দেওয়া এবং প্রকৃত সত্যটা মানুষের সামনে তুলে ধরাটা আমাদের কাজ। 

আমরা চাই মানুষ স্বাধীনভাবে ভাবুক, চলুক, কথা বলুক, এক হয়ে নিজেদের সমস্ত মৌলিক অধিকারের জন্য লড়াই করুক। বেশিরভাগ মানুষই আজকের এই দমবন্ধ ভয়ঙ্কর অবস্থাটা  চান না। তাঁরা প্রতিবাদ করছেন, প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন নিজের নিজের মতো করে। এখন চাই আমাদের সকলের মধ্যে সহযোগিতা। প্রত্যেকে কী ভাবছেন, কোথায় কী করছেন, কেমন করে লড়াই করছেন, তা সকলে জানুক। আলাদা আলাদা করে কাজগুলো হলেও সকলের মধ্যে একটা যোগাযোগ থাকুক, খবরাখবর আদানপ্রদান চলুক, মতবিনিময় হোক।

যে যেখানে যেভাবে প্রস্তুত হচ্ছেন, প্রচারের মাধ্যম হিসেবে লেখাপত্র, পুস্তিকা-পোস্টার, নাটক-গান-শিল্প-সিনেমা তৈরি করছেন, তা সকলের নজরে আসুক; ভাল লাগলে, দরকারি মনে হলে অন্যেরাও তাদের মহলে, তাদের মহল্লায় নিয়ে যাক, ছড়িয়ে দিক।

সময় মতো, প্রয়োজন মতো, একসঙ্গেও কিছু করার, এইসব কাজে সঙ্গে থাকার সহযোগিতা 

করার খোলা মঞ্চ ‘সহমন’। আসুন যার যার সাধ্যমতো নিজের নিজের এলাকায় পাড়ায় মহল্লায়, পারলে কাজের জায়গায় পড়শিদের সঙ্গে বসি। কথা বলি। নিজেদের মধ্যে কথায় আলাপে সংলাপে যাবতীয় মিথ্যা প্রচারের মুখোশ খুলে দিয়ে বহু দিনের পুষে রাখা ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে নিয়ে সহজ সম্পর্কের একটা পথ খোঁজার চেষ্টা করি। পড়শিকে ছুঁতে চাওয়া ‘সহমন’-এর এই কাজে আসুন আমরা সামিল হই। 

হাত বাড়ান। হাতে হাত ধরুন। সম্প্রীতির শক্তিতে সব ধরনের সাম্প্রদায়িকতাকে পরাস্ত করুন।