পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

গণদেবতার দেশে

  • 01 May, 2019
  • 1 Comment(s)
  • 5736 view(s)
  • লিখেছেন : সরিতা আহমেদ
বদলে যায় সম্পর্ক। বদলে যায় পাশাপাশি থাকা। বেঁধে থাকা মানুষগুলোকে দূরে ঠেলে দেয় দেশকাল। পাঁউরুটির ফাঙ্গাস সরিয়ে খাওয়ার যে যৌথ জীবন তার স্মৃতি-সন্ধান চলে এই প্রশ্নচিহ্নিত সময়ে। সরিতা আহমেদের কলাম।  


তখন ফেসবুক ছিল না, মেসেঞ্জার ছিল না, ফোনও ছিল না, টিভি... নাহ্ তাও নয়। যোগাযোগের পৃথিবীটা তখন আধুনিক ছিল না মোটেই। সেই সময় লোডশেডিং, লম্ফ জ্বালা, লাটিমের সুতো আর লাল চোখের গুরুজন নিয়েই আমরা আধুনিকতা পালন করতাম। বড্ড যাচ্ছেতাই রকম ছাড়া ছাড়া টাইপ জীবন ছিল আমাদের। মার্কেটে প্রতিযোগিতা এমন গাঁতিয়ে আসেনি, হেড-স্যার আর সংস্কৃত স্যারের মারের ভয়ে পড়া তৈরি হত রাত জেগে, পাশাপাশি বাড়ির রোববার বিকেলে উত্তম-সুচিত্রা যেমন তেমনি ভেসে আসত হারমোনিয়াম নিয়ে গানের রেওয়াজের সুর, কিছু বেহেড মাতাল তখনও রাতের মায়াজাল ছিঁড়ে বেমক্কা চেঁচিয়ে উঠত, চুরি চামারিও হত এদিক ওদিক, জাল কারবার বছরে এক আধটা নিশ্চয় শুনতাম, কিন্তু 'বালছাল', 'চু**', 'ফা**' বা 'ঘাপলা'-র মত শব্দেরা জন্মায়নি, পাড়ার মাঠে ছেলেদের সঙ্গেই ক্রিকেট খেলা আর পড়ার ফাঁকে গল্পের বইয়ের নিষিদ্ধ হাতছানিতে সায় দেওয়া, এ রকম একটা প্রি-মর্ডান বাংলা মিডিয়ামের দিন ছিল তা। সেই সব দিনে, ১৯৯৯-এ ঘরের ভেতর ৪৭ দিন ব্যাপী ময়ালকায়া বন্যাকে পেয়েছিলাম। আমাদের ছাদে আশ্রিত এক দম্পতির যমজ বাচ্চা হল, 'বাদল' আর 'বর্ষা' নামে, সেই সময় প্রসূতির পুষ্টিকর খাদ্য আর বাচ্চাদের জন্য দুধের আকালে বুঝেছিলাম অভাবের কষ্ট। ভাতের ফ্যানের সঙ্গে আটা মিশিয়ে একটা বিশ্রী দুর্গন্ধওয়ালা তরল চোঁচোঁ করে খেতে দেখেছি বানভাসি বাচ্চাদের। মন্টু নামে যে লোকটা আমাদের বাড়িতে পড়ে থাকত, ফাইফরমাস খেটে দিত, তাকে দেখতাম পেটে ভিজে গামছা বেঁধে ত্রাণের কাজে হাত লাগাতে। 'ভিজে গামছা কষে পেটে বেঁধে রাখলে খিদে পায় না', জেনেছিলাম ওর কাছেই। হেলিকপ্টার থেকে ছুঁড়ে দেওয়া চিড়ে মুড়ি গুড়-বাতাসা অথবা ওষুধ নিয়ে যখন কাতারে কাতারে লোকের কাড়াকাড়ি পড়ত, আর আমি সহ দুজন বাচ্চা জলে হামেশাই পিছলে পড়ে যেতাম, হাঁকুপাঁকু করে কাদামাখা জল খানিক ঠেলে, খানিক গিলে সেই লাইনে পৌঁছে দেখতাম সব শেষ হয়ে গেছে। সেই সময় বুঝেছিলাম খিদের জ্বালা কী! তখন এক দিন মন্টুকাকার মতই পেটে ভিজে গামছা বেঁধে থাকতে হয়েছিল। আমাদের স্কুলে যে অগুনতি মানুষ সে বার আশ্রয় নিয়েছিল তাদের কাছে ফেজ টুপি বা পৈতের কোনও মূল্য ছিল না। গাদাগাদি করে বেঁচে থাকতে থাকতে তাঁদের নাম বিভ্রাট হত হামেশাই। তাদের হাতে হাতে গাঁথা ইঁট-মাটির প্রাচীর, ত্রিপলের অস্থায়ী ছাদ আর বালির বস্তা দিয়ে জল আটকানো বাঁধগুলোই বেঁচে থাকার মন্ত্র শোনাত। নাহ, কোনও ঈশ্বর আল্লাহ্ সেই মানচিত্রে ছিলই না। সে দিন সবাই দেখেছিল একতা। খাট থেকে নেমে যে সকালটায় জলের মধ্যে পায়ের নিচে বিশাল এক সাপের ছটফটানি টের পেয়েছিলাম সেই দিন ভয় বুঝেছিলাম। নাহ্, তবু কেউ কিন্তু সাপ মারার জন্য লাঠি হাতে আসেনি। মানুষ গরু সাপ বাঁদর আর কোনও ক্রমে বাঁচানো চালের বস্তাগুলোর এক অদ্ভুত সহাবস্থান ছিল সেই সব দিনে। ভেসে যাওয়া গরু ছাগল মাছ অথবা বিষাক্ত প্রাণী, কেউ কারও শত্রু ছিল না। নৌকো করে যখন আমাদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়ার ফরমান এল, তখন একই নৌকায় ওরাও উঠেছিল। পদবী জেনে কাউকে নামানো হয়নি। সবাই সবাইকে বাঁচাতে চেয়েছিল শুধু। সেদিন গো-মাংসভুক আর নিরামিষাশীদের মধ্যেও যে বৈরিতা থাকতে পারে ঘুণাক্ষরেও কেউ ভাবতে পারেনি। ট্রেনের মধ্যে আলুর বস্তা ভরার মত করে যখন জ্যান্ত মানুষ ভরা হচ্ছিল, সবাই চাইছিল নিরাপদে বাঁচার এক টুকরো শুখা জমিন পেতে। সেই কালো রাতে গৌড় এক্সপ্রেসের নিঝুম কামরায় এক নেশাতুর লোক যখন বাথরুমের দরজা আটকে আমার দিকে তার থাবা বাড়িয়ে ধেয়ে এসেছিল সেদিন টের পেয়েছিলাম বোবায় ধরা আতঙ্ক কাকে বলে। তাকে ঠেলে ফেলে দিয়ে এক ছুটে যখন বাবা আর সাহাকাকু দুজনকেই জানালাম, আর সাহাকাকুই বাবার আগে দুটো কিল বসালো লোকটাকে, সেদিন বুঝেছিলাম স্নেহ কোন দিকে ধায়। তবু আমরা পাশাপাশিই ছিলাম। সমস্ত অসুন্দরকে সহ্য করে এক সঙ্গেই তো বাঁচতাম আমরা। তখন, বিফ আর পর্কের শত্রুতা জানা ছিল না, খিদেটা এক রকমই ছিল। তখন, মন্দির আর মসজিদের ধারে বাতাসা-লোভী হাতগুলো জড়ো হত দেওয়াল ভাঙাভাঙির চিন্তা ছাড়াই। তখন, লুঙ্গি বোরখা ধুতি বা ঘোমটার আকচাআকচি নিয়ে কারও মাথাই ঘামত না, পালাপার্বণে বছরে একটা বা দুটো নতুন পোষাক পাওয়ার লোভনীয় চাহিদা থাকত বলে। তাই হয়তো পাকা ছাদের অপেক্ষায় থাকা ভট্টাচায্যি কাকুর ছেলে সেবার নিশ্চিন্তে শুতে পেরেছিল ইঁটভাটার আমিনা বিবির কোলে, ফাহিমের সঙ্গেই। আধুনিকতার ছোঁয়াচ মুক্ত ওরা কাবার উপরে শিবের ফটো কেমন করে বসতে পারে’, এ নিয়ে ভাবার সময়ই জোটাতে পারে না। কাবার অবস্থান নিয়েই স্বচ্ছ ধারণা নেই তাদের। স্বচ্ছ ধারণা কি ওদেরও আছে যারা বোমা বাঁধে, লাঠি-চাপাতি চালায়, ঘর পোড়ায়, মিছিল করে, বিক্ষোভে শিশু এবং নারীদের ঢাল বানায়! আজকে আমাদের চেনা পাড়াগুলোয় অভাব’-এর বড় অভাব। এই স্বচ্ছল আধুনিক সমাজটার একটা মোক্ষম মন্বন্তর কিম্বা ভয়ংকর বন্যা দরকার। তখন মানুষ বুঝবে ভালবাসা কী, বেঁধে বেঁধে থাকার বাসনা কেমন দেখতে, প্রিয় পোষ্য জলে ভেসে গেলে কেমন কষ্ট, পাঁউরুটির ফাংগাস সরিয়ে খাওয়ার পর কতটা তৃপ্তি খিদে পেটে! রবি ঠাকুরের গানে, শুকতারা পাতায়, মোগলি আর সিঞ্চ্যানের সরলতায় অথবা পিকলুর প্রথম আঁকা ছবির মধ্যে ঈশ্বর দর্শনের আনন্দ কতটা, সেটা আজকের ঈশ্বর ভক্তদের জানা খুব দরকার। আজ তাই বিষাক্ত বিষন্ন বিকেলে এত রক্ত কেন’— এই টপিক বাদ দিয়ে, বরং আমার রাফখাতার প্রতিটা ছেঁড়া পাতা একটি সর্বজনীন অভাব’-এর প্রার্থনায় রচনা লেখে। বুকশেলফের দাগিয়ে পড়া বইগুলোয়ের ফাঁকে ফাঁকে লুকানো ঈশ্বর তখন মনে মনে আশীর্বাদ করেন। আমি নিভৃতে টের পাই।

1 Comments

Shoubhik Sanyal

05 May, 2019

Ei Lekha porte porte mone hochhilo, ekta canvas fute utche chokher samne. Jekhane, ekta gota gram bidhhosto prokriti r tandob lilai, kintu manus koto drihovabe valobasar sokto dorite abodhho hoe, joy kore niechilo khudha ke, sojon o ghorbari haranor dukhhoke, etai monussotter joy, prokritir kache.

Post Comment