পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

মহরম ‘হ্যাপি’ নয়

  • 16 September, 2019
  • 0 Comment(s)
  • 3232 view(s)
  • লিখেছেন : সেখ সাহেবুল হক
পারস্পরিক জানার জায়গাটা তৈরি হয়নি বলে একটা শোকের দিনে ‘শুভ মহরম’ বা ‘হ্যাপি মহরম’ জাতীয় শুভেচ্ছা ইনবক্সে জমে। আজও জমছে। ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগলেও, এই ভুল বার্তার পেছোনে একশ্রেণীর হল্লাবাজ মুসলমানের নাচনকোঁদন দায়ী।

বয়সটা যখন সবে পাঁচ বা সাড়ে পাঁচ। হাওড়ার গ্রামের বাড়িতে প্রথমবার মায়ের মুখে শোনা কারবালার বেদনাঘন আখ্যান। হাউহাউ করে কেঁদেছিলাম। মা বুঝিয়েছিলেন জগতে দুটো পথ হয়, একটা সত্যের পথ এবং অন্যটা মন্দের পথ। সত্যের জন্য লড়াই করে বীরের মৃত্যু অর্জনটাও সৌভাগ্যের। বড় হয়ে বিভিন্ন বই এবং সাহিত্যে মহরম সম্পর্কে আরো কিছু আঙ্গিকে জানার দরজা উন্মোচিত হয়।

মহরম পুরোপুরিভাবে একটি শোকের দিন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর দৌহিত্র ইমাম হোসেন (রাঃ) অবৈধ ভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত এজিদের বশ্যতা স্বীকার না করে, এক অসম যুদ্ধের মাধ্যমে মহরম মাসের ১০ তারিখে প্রাণ দিয়ে শাহাদাৎ বরণ করেন। সেদিন ফোরাত নদীর পারে কারবালার প্রান্তরে ইমাম হোসেন (রাঃ) তাঁর শিশু পুত্রসহ সবাইকে নির্দয়ভাবে শহীদ করেছিল এজিদের সৈন্যদল। সত্য ও ন্যায়ের পথে ইমাম হোসেন(রাঃ) ও তাঁর পরিবার সেদিন রক্তের বিনিময়ে ইসলামী সত্যের বীজবপন করে গিয়েছিলেন। তাঁদের উৎসর্গীকৃত জীবন ইসলামের ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়েছে। ১০ই মহরম দিনটি আপামর সাধারণ মুসলমানের কাছে প্রবল শ্রদ্ধার। কারবালার ঘটনা ছাড়াও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন নবীর সময়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এইদিনে ঘটেছিলো।

শরিয়তি বিধান অনুসারে এই দিন শোকের আবহে পালনের উপায় হলো নিয়মমতো নামাজ পড়া, সম্ভব হলে রোজা রাখা এবং আড়ম্বরহীনভাবে দিনটি অতিবাহিত করা। দুঃখের বিষয়, খুব কম সংখ্যক মুসলমান এভাবে মহরম পালন করেন।

মহরমে শোকের নামে অস্ত্র নিয়ে আস্ফালন এক নিম্নরুচির কার্যকলাপ। সভ্য সমাজে যা একেবারে বেমানান। অযথা যানজট করে শহর জুড়ে হল্লা করার মধ্যে ধর্মীয় বিধান পালনের নিয়ম নেই। এ হল উগ্রতার বহিঃপ্রকাশ।

মদে চুর হয়ে প্রকাশ্যে নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করাটা বর্বরোচিত। মদ যেখানে ইসলামে নিষিদ্ধ, সেখানে মদ খেয়ে নাচানাচির মধ্যে কোনও নিয়মই রক্ষিত হয় না। গায়ে সূচ ফুটিয়ে, নিজেকে রক্তাক্ত করা ইসলামবিরুদ্ধ।

এই ধরণের আচরণ চমকে দিয়ে বীরত্ব প্রদর্শণের ব্যর্থ চেষ্টা মাত্র। গোটা গায়ে সূচ ফুটিয়ে, উন্মুক্ত পিঠ ক্ষতবিক্ষত করে নিজেকে হিরো ভাবার মধ্যে রয়েছে অফুরান অশিক্ষা।

কোনও প্রিয় মানুষের মৃত্যুদিবসে তাঁকে শ্রদ্ধা প্রদর্শনের মাধ্যম কখনও নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করা বা ডিজে বক্স বাজিয়ে উল্লাস প্রকাশ হতে পারে না। উল্টে লোকদেখানো ন্যাকাকান্নায় অশ্রদ্ধাজনক অনেক কিছু প্রকাশ্যে আসে। ভিন্নধর্মী মানুষের কাছে ভুল বার্তা যায়। জমা ভিড়ে গুটখার পিকে ভরে যাওয়া চত্বর, মহিলাদের কটুক্তির ঘটনাও পরিলক্ষিত হয়। ধর্মীয়ভাবেও যা প্রবল নিন্দনীয়। পরিচ্ছন্নতা এবং শালীনতা ইসলামের প্রধান শর্ত।

একবার বালিগঞ্জ স্টেশনের ভিড়ে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ করে হায় হোসেন, হায় হোসেন বলে প্রবল জোরে চিৎকার করে কয়েকটি ছেলে লম্বা বাঁশকে টানতে টানতে ছুটছে। স্টেশনে বিরক্ত মানুষজনের এটিকেই ইসলাম ভেবে নেওয়াটা খুব স্বাভাবিক। শুধু বালিগঞ্জ নয়, শিয়ালদা, পার্ক সার্কাস এবং মল্লিকপুর স্টেশনেও এমন হয়। একটু ভুলচুক হলে কারো গায়ে লেগে যেতে পারে। এই অসভ্যতাকে ধর্ম বলে চালাতে চাওয়াই ধর্মের চোখে ভুল।

পারস্পরিক জানার জায়গাটা তৈরি হয়নি বলে একটা শোকের দিনে ‘শুভ মহরম’ বা ‘হ্যাপি মহরম’ জাতীয় শুভেচ্ছা ইনবক্সে জমে। আজও জমছে। ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগলেও, এই ভুল বার্তার পেছোনে একশ্রেণীর হল্লাবাজ মুসলমানের নাচনকোঁদন দায়ী। ধর্মীয় বিধানের বাইরে গিয়ে ফুর্তি করার ঘটনা প্রত্যেকের ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু ধর্মকে সেই নোংরামির উপলক্ষ্য বানাতে চাওয়াটা জ্ঞানে বা অজ্ঞানে গোছানো ধড়িবাজি।

সর্বোপরি, মহরমে অস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে মিছিল বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। প্রশাসনকে কড়া পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। মহরম অন্ততপক্ষে অস্ত্রমুক্ত হলে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলির পক্ষে অশান্তি ছড়ানো কঠিন হবে। সুস্থতা আসবে। শিয়া বা সুন্নি মূল বিষয় নয়। অস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে যে কোনো অসভ্যতা বন্ধ হোক। মহরমে অযথা রক্ত না ঝরিয়ে, সেই রক্ত দান করে প্রাণ বাঁচালে তা সমাজের কাজে লাগবে৷

ছবি - ঈমাম আলী মোল্লা




0 Comments

Post Comment