পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

সমাজ নিদ্রা গিয়েছে

  • 05 August, 2019
  • 0 Comment(s)
  • 2312 view(s)
  • লিখেছেন : চম্পা খাতুন
পারস্পরিক সম্পর্ক, ভালবাসা জাতিধর্মনিরপেক্ষ। হিংসা-বিদ্বেষ কৃত্রিম; প্রেম, সহিষ্ণুতা হল স্বাভাবিক। তবু মানুষ কেন অন্য মানুষকে ঘৃণা করে! হিংসা মানুষের স্বগত ধর্ম নয়, তার প্রধান বৈশিষ্ট্য শান্তরস। তবু পিটিয়ে মারা হচ্ছে অন্য মানুষকে। কেন? কোন দেশে বাস করি আমরা?

ট্রেনে প্রধানমন্ত্রীর নাম বলতে না পারায় ঠাটিয়ে চড় খেতে হল কালিয়াচকের জামাল মোমিনকেএই চড় কি কেবল বিস্ময়ে! ক্ষমতাবান ছেলেগুলি এক হতদরিদ্র ছেলের জ্ঞানের সীমা দেখে আশ্চর্য হয়ে অপমানিত করলনা, চড়-অপমানের নেপথ্যে আসলে ঘৃণা ছিল, আছেঅন্য ভাবে বেঁচে থাকা মানুষের প্রতি জমতে থাকা বিদ্বেষবিস্ময় হল ধর্মের আদি অনুভূতিদেবতার প্রতি, সৃষ্টিকর্তার প্রতি কত শত বিস্ময়বোধক স্তুতি রচিত হয়েছে কত যুগ ধরে, দেশে দেশে, কালে কালেধর্মের সেই বিস্ময় কিভাবে সীমাহীন ঘৃণায় পরিণত হয়ে গেল? তার উত্তর আছে সমাজের কাছে? উত্তর ছিল কি সেই সব পিতর: (মানুষের পূর্বপুরুষ যারা মৃত) কাছে, যাদের শ্বাসে আজও আমাদের পৃথিবীর বাতাস বয়ে নিয়ে চলেছেবৈদিক সমাজে পিতর:-র অবস্হান দেবতাদের নীচে, কিন্তু উপদেবতাদের ওপরেজামাল মোমিন আর অপমানিত করতে থাকা ছেলেগুলোর পিতর: একই ছিলহয়তো আদিবাসী রূপে, নয়তো বৌদ্ধ-জৈন রূপে, নয়ত হিন্দু অথবা মুসলমান রূপেএকই জল হাওয়ায় বেড়ে ওঠা মানুষের মাঝে এই অপমানের ঘৃণিত জীবন কেন গড়ে উঠল?

প্রাচীন কালে ছিল ধর্মের প্রধান দুটি স্তম্ভ--ভয় আর বিস্ময় সব কিছু হারানোর ভয়, প্রিয়জনের মৃত্যু, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, ক্ষয়-ক্ষতি, ভালো না থাকার ভয়। আর অন্যদিকে অপার বিস্ময় চ্ন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্রের নিয়মনীতির ওপর। দিন-রাত্রি, ঋতু বৈচিত্র, প্রকৃতির সৌন্দর্য্য আদিম মানুষকে বিষ্ময়ে ভরিয়ে রাখত। তাই সে দেবতার সৃষ্টি করে। তার হাতে জীবনের সব দায় চাপিয়ে নিশ্চিন্তে থাকতে চায়। ধর্মে ভয় এখনো আছে। কিন্তু ধর্মের বিস্ময় আর নেই। মানুষের সেই সরল ভাবনার পথ ক্রমশ জটিল হয়েছে। ধর্মের অবাক বিস্ময় বহুকাল বিপন্ন। সেই সুযোগে জায়গা করে নিয়েছে যুক্তিহীন বিশ্বাস, ঘৃণা ও হিংসা। ধর্মের আধুনিকতা যেন এই গুলি ছাড়া হবার নয়ঘৃণা বাড়াতে সাহায্য করছে ক্ষমতালোভী রাজনীতির নেতাযাদের অঙ্গুলিহেলনে ও দাপটে বিকারগ্রস্হ ধর্মধ্বজাধারীরা মানুষ খুন করছে, অপমান করছে অন্য ধর্মের মানুষকে। পুরো পৃথিবী জুড়েই চলছে এ তাণ্ডব। দলবদ্ধ কিছু মানুষ চিরকাল সুযোগ খুঁজে গেছে আখের গোছানোর, কিছু মানুষ নাম যশ প্রতিপত্তির জন্য মানুষে মানুষে হানাহানি ঘটাতেও পিছপা হয়নি। আর মুষ্ঠিমেয় কিছু মানুষ স্বপ্ন বুনেছে মানবের সম্মানের জন্য, প্রকৃত ভালবাসার সম্পর্কের জন্য। যথারীতি শেষ দলের লোকেরা সংখ্যায় ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে উঠছে ক্রমশ। তাণ্ডব চালানোর হাতিয়ার সময় সময় বদলে যায়। কোথাও তা গরু তো কখনো তা শুয়োর। কোথাও হাতে মারা, তো কোথাও ভাতে মারা। কোথাও জ্যান্ত পোড়ানো তো কোথাও অপমান চড় লাথি। অন্যরকম জীবন যাপন, অন্যরকম খাদ্যাভাস একেবারেই না-পসন্দ। তাই রাজনৈতিক পশু হিসেবে গরুর জায়গা অন্য কেউ নিতে পারল না। প্রাচীন যুগের একটা সময়ে সমাজে অল্প কিছু ধনী ও সংখ্যায় অনেক গরীব ছিল। চাষবাসের জন্য গরুর প্রয়োজন ছিল সর্বাগ্রে। যার যত বেশি গরু সে তত বেশি ক্ষমতাবান, তত বেশি ধনী। গরুই ছিল ধনের একক। জিনিসের দাম নির্ধারিত হত গরুর সংখ্যার বিনিময়ে। গরুর মাংস তখন যজ্ঞে হব্য হিসেবে দেবার রীতি ছিল। গরু চুরি তাই রোজকার ঘটনা ছিল। যজ্ঞে বেশি বেশি গরু শেষ হয়ে যাচ্ছিল তাই গরুর মাংস খাবার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হল। যাজ্ঞবল্ক্য এই নিষেধ মানলেন না। তিনি বললেন – “আমি কিন্তু গোমাংস খাব যদি রান্নাটা ভালো হয়।” খিদের তাড়নায় সমাজের নিম্নশ্রেনীর মানুষ চণ্ডাল সম্প্রদায় কুকুরের মাংস ও নাড়ি ভুড়ি রান্না করে খেত। কুকুর খাবার অপরাধে তাদের ঘৃণ্য করে রাখা হত। আর এখন গরু খাবার অপরাধে গরুভক্ষণকারীদের ঘৃণ্য করে রাখা হচ্ছে। কেবলমাত্র গরু খাবার অপরাধে তার নিজ প্রিয় দেশে কতজন মানুষ মারা গেল তার হিসেব নিকেশ রাখার দায় কারো নেই। অন্যভাবে বাঁচতে চাওয়া মানুষ কেবল আলাদা জীবন যাপন করার জন্যই ঘৃণার পাত্র। এই ঘৃণা খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে চাগিয়ে দিতে পারলে আর ভাবনার কিছু নেই। প্রিয় দেশ আমার। হতদরিদ্র মানুষের মধ্যে ঘৃণা ভরে গেলে কি নিয়ে থাকবে সবাই। এদেশের হাজার-একটা সমস্যা। তার মাঝে, চিরটা কাল উজ্জ্বল হয়ে যা ছিল, তা হল মানুষে মানুষে পারস্পরিক প্রীতির সম্পর্ক ও বাঁধনএ সম্পর্ক অর্জন করতে হয়েছে ইতিহাসের চড়াই উৎরাই পথ বেয়ে। মানুষে মানুষে এমন পারস্পরিক সম্পর্ক পৃথিবীর আর কোন দেশে দেখতে পাওয়া যায়? প্রাচুর্য্য আমাদের নেই, এত কিছু না থাকার মাঝে ভালোবাসার সম্পর্কের মাঝে যে স্বস্তি ছিল, তা উধাও হয়ে গেলে ভারতবাসীর বাঁচার পথ কোনদিকে বইবে? বড়লোক পয়সাওয়ালা, ক্ষমতাবান মানুষের কিছু হবে না। কিন্তু খেটে খাওয়া মানুষের কি হবে কেউ কি ভেবে দেখেছে? প্রাণ দেবে অশিক্ষিত খেটে খাওয়া হিন্দু মুসলমান। আর চড় থাপ্পড় হজম করে, বাড়িতে বউ বাচ্চাকে কিছু না জানিয়ে ফিরে যেতে হয় দূরে। পেটের টানে। সেরকমই আমার এক সম্পর্কিত ভাই সুদূর গুজরাট থেকে ফোনে প্রশ্ন করে, জাহাজের মাল ওঠা-নামা করে খেয়ে-দেয়ে মাসে হাজার আটেক টাকা থেকে যায়। কতদিন এভাবে খাটলে, কত টাকা রোজকার করলে ব্যাঙ্কের সুদে তার সংসার চলে যাওয়ার টাকা হয়ে যাবে? জৎসই উত্তর থাকে না বলে মধ্যবিত্ত ছকে কথা পাল্টে দিই। তবু প্রশ্ন পিছু ছাড়ে না। মানুষে মানুষে রুচিসম্মত সাম্যের কথা তাত্ত্বিকেরা বলতে পারবেন। কিন্তু কালের পথ বেয়ে এদেশের প্রাচীন সমাজ, বৈদিক সমাজ, জৈন-বৌদ্ধের সমাজ, সন্ন্যাসীর সমাজ, সুফি-সন্তের সমাজ, আওলিয়া-পীরের সমাজ, চর্যাপদের সমাজ, নাথপ্ন্থী যোগীর সমাজ, বৈষ্ণব-বাউল-ফকিরের সমাজ আর সেই সব সমাজের অগণিত মৃত মানুষ, পিতর: কখনো ভেবেছিল কি তাদের সন্তানেরা এভাবে একে অপরকে অপমানিত করে বেঁচে থাকার পথ খুঁজে নেবে? জামাল কিন্তু সেদিন ট্রেনে একা ছিল না। আশে-পাশে অনেক মানুষ ছিল। তবু জামালের মতো অসহায় হতদরিদ্র মানুষকে কেন নিজের দেশের মাটিতে চড়-থাপ্পড় খেতে হবে? তার উত্তর কে দেবে? শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সমাজ? সমাজ তো নিদ্রিত!


0 Comments

Post Comment